ঢাকা : গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটির কাছে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের অনেকেই দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নন।
কারণ, বিভিন্ন সময় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচনা ঝড় উঠায় তারা ইসির দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের বিতর্কিত করতে চান না।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটির কাছে ৩২২ জনের নামের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের পক্ষে ১৩৬ জন, ব্যক্তি ও পেশাজীবী সংগঠন থেকে বাকি নাম প্রস্তাব করা হয়।
এছাড়া নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৬টি দল কোনো নাম জমা দেয়নি। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে ইতোমধ্যে চার দফা বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এই কমিটি।
কিন্তু সার্চ কমিটিতে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তারা এই দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নন। কারণ রাকিব কমিশন আর হুদা কমিশনের কিছু বির্তর্কিত কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে সমালোচিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে এড়িয়ে চলতে চান তারা।
প্রস্তাবিতদের নাম প্রকাশের পর কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অধিকাংশই সরাসরি না করেছেন। তাদের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিলে তাদের নিরপেক্ষতা নষ্ট হতে পারে। উল্টো বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে তাদের দীর্ঘদিনের সুনামও নষ্ট হতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি কয়েকজন। আর দুই চারজন বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
গত সোমবার হুদা কমিশনের মেযাদ শেষ হওয়ায় সবার চোখ নতুন কমিশনে কারা আসছেন সেদিকে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে তৃতীয়বারের মতো সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাবের জন্য এই কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কাছে নাম চেয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে যারা আগ্রহী তাদেরকেও নাম প্রস্তাব করার সুযোগ দেওয়া হয়।
গত ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত নাম দেওয়ার সুযোগ ছিল। পরে যেসব দল নাম জমা দেয়নি, তাদের সোমবার বিকেল পর্যন্ত নাম জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রকাশ করে ৩২২ জনের নাম।
এর মধ্যে আছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সাবেক সেনাপ্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার।
মন্ত্রিপরিষদের যুগ্ম সচিক শফিউল আজিম জানান, নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করেই সবাই যার যার নাম জমা দিয়েছেন। নতুন ইসির জন্য মনোনীত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে ন্যূনতম ৫০ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি অথবা বিচারিক পদে তার ২০ বছর কিংবা তার বেশি সময় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে
এবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে সার্চ কমিটিতে নাম জমা পড়লেও সাংবিধানিক পদ নিয়ে নির্বাচন ভবনে যেতে চান না আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
তিনি বলেন, যারা আমার নাম প্রস্তাব করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে আমি সেখানে যেতে চাই না।
নির্বাচনে ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সোচ্চার ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের অবস্থানও বিচারপতি মানিকের মতো। সার্চ কমিটি যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেছে তাদের মধ্যে বদিউল আলম মজুমদারও ছিলেন। তিনিই কমিটির কাছে জমা পড়া নাম প্রকাশ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে নানা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আসা এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, আমি তো সার্চ কমিটিকে লিখিতভাবেই জানিয়ে দিয়েছি যে আমি আগ্রহী নই। তবে বরাবর নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে আসা এই নির্বাচন বিশ্লেষক কী কারণে এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন, সেটা জানাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যিনি বা যারা আমার নাম দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছি না।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন। তিনি বলেন, শিক্ষকতাই আমার পেশা। এ পেশা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাই না।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, জানি না কে আমার নাম প্রস্তাব করেছে। আমি এগুলো নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে চাই না।
আর কৌশলী উত্তর দেন সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, যারা আমার নাম দিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে এমন দায়িত্ব যদি আমাকে দেওয়া হয়, নিশ্চয়ই তার আগে আমার সঙ্গে কথা বলে নেবেন। তাই আমি এ মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে আন্দোলন করা সাবেক চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করার আগে ভালোভাবে বুঝে নিতে চান। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি বলেন, এটা আমার নিজের বুঝতে হবে, তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব এবং আপনাদের জানাতে পারব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে আমি এখন কথা বলতে চাই না। এ বিষয়ে এখনই কথা বলা ঠিক হবে না।
এছাড়া ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি শাসনামলের পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়েছিল, তার উপদেষ্টা পদ নেওয়ার পর পদত্যাগ করা মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের নামও রয়েছে সার্চ কমিটিতে জমা পড়া তালিকায়। তবে তিনি নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী কি না, এই বিষয়টি জানা গেল না কথা বলতে আগ্রহী না হওয়ার কারণে।
এদিকে, দুই উপাচার্যের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করা নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ জানিয়েছেন, গতবারও তিনি আশা করেছিলেন কমিশনে স্থান পাবেন। এবার রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব দিলে তিনি আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের এই অধ্যাপক দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন। তিনি জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন যেটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সুশাসন নিয়েও কাজ করে।
নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বলেন, গতবার আমার নাম ১০ জনের তালিকায় ছিল। তবে তখনো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পাইনি বলে দ্বিধান্বিত ছিলাম। পরে যেহেতু একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছি, তাই এবার আমার মধ্যে দ্বিধা নেই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি আমাকে নিয়োগ দেন তাহলে আমি নিশ্চয় গ্রহণ করব।
তার মতে, এই দায়িত্বের জন্য তিনি খুবই দক্ষ। তিনি বলেন, দেশ-বিদেশে গত ৩০ বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা তা জাতির এই ক্রান্তিকালে কাজে লাগাতে চাই।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রথম যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশনের কমিশনার আবদুল মোবারক আবার কমিশনে যেতে আগ্রহী।
মোবারক বলেন, যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে দায়িত্ব দেন, আমি অবশ্যই সেই দায়িত্ব নেব। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনা করা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জন করেছিল।
অন্যদিকে, অধ্যাপক মুনতাসির মামুন মনে করেন, কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর। অনুসন্ধান কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া এই অধ্যাপক মনে করেন, একেবারে নিরপেক্ষ ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কখনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করা সম্ভব হবে না। যে দেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি আছে, সে দেশে কখনোই কোনো বিষয় ঐকমত্যে পৌঁছাবে না।
লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের মতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দৃঢ়চেতা, সৎ ও সাহসী ব্যক্তিদের প্রয়োজন, যারা সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ সৎ ও সাহসী মানুষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করার ঘটনা ঘটে তাকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো ক্ষমতা যাদের আছে, তারাই এই কমিশনে থাকবেন।
শাহরিয়ার কবির বলেন, সাহসের সঙ্গে সাংবিধানিক দায়িত্বটা পালন করেন। সংবিধানে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে বা অন্য কোনো দেশে এতটা ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু ক্ষমতাটা তারা প্রয়োগ করছেন না।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :