• ঢাকা
  • রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১
দিশেহারা মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার

জ্বালানি সংকটের মুখে সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৬, ২০২২, ০১:৪৭ পিএম
জ্বালানি সংকটের মুখে সরকার

ঢাকা : বিশ্বজুড়ে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তেজনা। এ যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক, ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে বাড়তে শুরু করছে সবধরনের পণ্যের দাম। আর পণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, প্রতিদিন দফায় দফায় বাড়ছে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। চলমান যুদ্ধ দীর্ঘ হলে দেশে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

ইতোমধ্যে যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশেও ফুরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এতে দিশেহারা মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার।

কারণ গত দুই বছর ধরে করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতিতে যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এ বছরের শুরুতে করোনার প্রভাব কমে আসায় খানিকটা চাঙ্গা হচ্ছিল অর্থনীতি। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আবারো বিপর্যয় নামতে পারে।

উদ্বেগের বিষয়, জ্বালানি সংকট দেখা দিলে খাদ্যদ্রব্যের দাম আরো বাড়বে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এলএনজির আমদানি বাড়াতে জ্বালানি রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে কাতার সফরে গিয়ে সেদেশের জ্বালানি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অতিরিক্ত তরলীকৃত গ্যাস-এলএনজি কেনা নিয়ে দেন দরবার করছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

গত ফেব্রুয়ারিতেই খাদ্যপণ্য বিশেষ করে ভোজ্যতেল ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএও শুক্রবার (৪ মার্চ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে উঠে এসেছে খাদ্যপণ্যের দামের এমন ভয়াবহ চিত্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক বেড়ে পৌঁছেছে ১৪০ দশমিক ৭ পয়েন্টে। আগের মাস জানুয়ারিতে কিছুটা কমে খাদ্যপণ্যের মূল্য সূচক দাঁড়িয়েছিল ১৩৫ দশমিক ৭ পয়েন্টে।

এদিকে, ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেল প্রতি ছিল ১১১.২৬ ডলার। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়ে রেকর্ড অবস্থানে চলে গেছে। এটা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। কোনো কারণে রাশিয়া তেল রফতানি বন্ধ করলে এই দাম আরও বাড়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববাজারে জ্বালানির এই পরিস্থিতিতে শঙ্কিত বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও যুদ্ধের আঁঁচ এখনো পুরোপুরি বাংলাদেশের ওপর পড়েনি। কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সেটা সামলানো বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, জ্বালানি তেলের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে দাম ও আমদানি খরচ দুটোই বাড়বে।

জানা গেছে, সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে বছরে ৬২ লাখ টন তরল জ্বালানির চাহিদা রয়েছে। এ সব জ্বালানির মধ্যে রয়েছে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ জ্বালানি দরকার হয়, তার প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানি করা মোট জ্বালানির মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ পরিশোধিত জ্বালানি। এটি অপরিশোধিত তেলের চেয়ে কয়েকগুণ ব্যয়বহুল। আর এই জ্বালানির বেশিরভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন- বিপিসিও যুদ্ধের কারণে জ্বালানি আমদানির ওপর প্রভাব পড়ার আশংকা করছে।

প্রতিষ্ঠানটি এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে সেচ মৌসুমে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির চুক্তি রয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এই পরিমাণ জ্বালানি সরবরাহ করবে। এরমধ্যে রয়েছে পিটিটি থাইল্যান্ড, বিএসপি ইন্দোনেশিয়া, ইউনিপেক চায়না, ইনক ইউএই, পেট্রোচায়না ও পিটিসিএল মালয়েশিয়া।

তিনি জানান, বিশ্ববাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেল প্রতি দাম ৯২ ডলারের চেয়ে বেশি হলেই লোকসান গুণতে হয় বিপিসি। অথচ চলতি মাসে প্রতি ব্যারেল ডিজেল ১১৫ ডলারে আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকা লোকসান গুণছে বিপিসি। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে লোকসানের বোঝা আরও বাড়বে।

এদিকে, রান্নায় ব্যবহারে প্রতিদিন এক লাখ টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চাহিদা রয়েছে। আর এই এলপিজির পুরোটাই আমদানি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বর্তমানে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে এলপিজি সরবরাহেও ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।

ওমেরা এলপিজির প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা শামসুল হক আহমেদ জানান, বিশ্ববাজারে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সরবরাহকারীরা এলপিজি দিতে বেশি সময় নিচ্ছে। এর ফলে আর কিছুদিন পরই দেখা দিতে পারে সংকট।

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবের নামে আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এলপিজির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

সরকারি রেগুলেটরি অথরিটিকেও দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেকটা বাধ্য করা হচ্ছে। এখন বাজারে ১২ কেজির এলপিজির দাম এক হাজার ৩৯১ টাকা করা হয়েছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের পক্ষে আয় ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলপিজির ৯৮ শতাংশই আমদানি করতে হয়। যার পুরোটা আসে বেসরকারি মাধ্যমে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বর্তমানে বছরে প্রায় ১২ লাখ টনের বেশি এলপিজি আমদানি করে বোতলজাত করে ভোক্তাপর্যায়ে সরবরাহ করছেন। এ খাতে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

এলপিজি গ্যাস পরিবেশক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি খোরশেদুর রহমান বলেন, গৃহস্থালিতে দিন দিন এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। ব্যবসায়ের পরিধিও বাড়ছে। বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নিয়েছে এলপিজির বাজার। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজিএলের সক্ষমতা আরও কমেছে। গত ১২ বছর নতুন কোনো সিলিন্ডার বাড়েনি।

বর্তমানে বিশ্ব বাজারে এলপিজির অন্যতম উপাদান প্রোপেনের দাম প্রতি মেট্রিক টন ৮৯৫ ডলার এবং বিউটেন ৯২০ ডলার। এ মূল্য গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের মার্চে প্রতি মেট্রিক টন প্রোপেনের দাম ছিল ৬২৫ ডলার এবং বিউটেন ৫৯৫ ডলার।

করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিলে এলপিজির দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই মাসে প্রোপেন মাত্র ২৩০ ডলার এবং বিউটেন ২৪০ ডলার ছিল। এলপিজির বিশ্ববাজারে সৌদি আরামকোর মূল্য অনুযায়ী বিশ্বে এলপিজির দাম নির্ধারিত হয়।

কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজার চরম উত্তপ্ত। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত জ্বালানি মিলবে কি না এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। কারণ বাংলাদেশ জ্বালানির প্রায় পুরোটাই বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। তবে এমন জরুরি সময় সামনে এলে মোকাবিলার জন্য তিন মাসের পরিকল্পনা থাকা উচিত।

তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান করার জন্য বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে চড়া দামে এলএনজি সরবরাহ করছে, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।

আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম রেকর্ড হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ যেহেতু জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে পুরোটাই আমদানি নির্ভর। তাই প্রভাব পড়বেই। তবে এলএনজি এলপিজির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকায় এখনই বেশি চিন্তার কারণ নেই।

বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানির জন্য ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি কাতারের জ্বালানি ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

এই সমঝোতা অনুযায়ী বছরে ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ১৫ বছর মেয়াদী এলএনজি সেলস অ্যান্ড পারচেজ এগ্রিমেন্ট-এসপিএ স্বাক্ষর হয় ২০১৭ সালে।

ওই চুক্তির আওতায় কাতার থেকে বাংলাদেশ বছরে দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করছে। এখন এই আমদানি আরও বাড়াতে চায় জ্বালানি বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে এ খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এলএনজির ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলা এই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করে। এই পরিমাণ অর্থ ছাড় সম্ভব নয় বলে গ্যাসের দাম বাড়াতে পেট্রোবাংলাকে পরামর্শ দিয়েছিল অর্থবিভাগ।

এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যদি দীর্ঘসময় ধরে চললে বাংলাদেশের জন্য চিন্তার বিষয়। তাহলে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে যুদ্ধ কতদিন চলে সেটার ওপর।

উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে গত বছরের নভেম্বর কেরোসিন ও ডিজেলে লিটার প্রতি ১৫ টাকা করে দাম বাড়ায় সরকার। ওই সময়ে গণপরিবহনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে যে প্রভাব পড়ে, তা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!