• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২৫, ২০২২, ০১:৫৩ পিএম
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকার

ঢাকা : দিন দিন কমে আসছে করোনা সংক্রমণ। দুই বছর ধরে চলা এই করোনা মহামারিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে প্রতিদিন দফায় দফায় বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যের দাম।

বিশেষ করে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে। কম দামে খাদ্যপণ্য পাওয়ার আশায় শহরের নিম্নবিত্ত মানুষ, এমনকি মধ্যবিত্তের অনেকেই টিসিবির গাড়ির পেছনে ছুটছে। দিন দিন টিসিবির গাড়ির পেছনে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের এই ভিড়।

ফলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ কতটুকু ভোগ করতে পারছে, তা নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। তাই রমজানের আগেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হচ্ছে সরকার। কারণ এক সপ্তাহ পর শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠনের কথাও ভাবছে সরকার।

ইতিমধ্যে এক কোটি পরিবারকে বিশেষ কার্ডও দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে কয়েকটি নিত্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পাচ্ছে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ। কিন্তু এগুলো মুল সমস্যা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টামাত্র।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের অবৈধ পণ্য মজুত। আর পেঁয়াজ-রসুনসহ কিছু খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেসব দেশের রপ্তানিনীতি পরিবর্তন দায়ী।

এসবের সঙ্গে এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধিকেও দায়ী করা হচ্ছে। ফড়িয়া, আড়তদার, পাইকার, ক্ষুদ্র কারবারিসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং গণপরিবহন ব্যবস্থায় অবৈধ চাঁদাবাজিও রয়েছে। যার কারণে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পণ্যের দামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ গুণ পার্থক্য দেখা যায়।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন, সরকার দ্রুত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে।

তিনি সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা আশা করি, বাজারের এই সংকট থাকবে না। অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব।

তিনি বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে, সরকার সংশ্লিষ্টদের দাবি, রমজান মাস সামনে রেখে সব ধরনের পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে মজুত চাহিদার দ্বিগুণ। তাই আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে।

এ বিষয়ে গত বুধবার ব্যবসায়ী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুপারশপ ও বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ড্যাম) মতবিনিময় সভা হছে। এসময় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আব্দুল গাফফার খান পণ্যের মজুত বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেন ।

তিনি বলেন, বাজারে কিছুদিন আগে যে অস্বস্তি বিরাজ করছিল, তা এখন অনেকটা কমেছে। বাজার পরিস্থিতি বেশ স্বস্তির মধ্যে এসেছে। রমজানে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। পর্যাপ্ত মজুত থাকায় দাম কমে যাবে বলে আশা করছি।

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাজারে অযথা কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না। সামঞ্জস্যের মধ্যে থেকে মুনাফা করুন। অতিরিক্ত লোভের ফাঁদে পড়বেন না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্যই মূল্যতালিকা টাঙিয়ে রাখবেন। কত দামে পণ্য কিনছেন, কত দামে বিক্রি করছেন, সব ধরনের রশিদ সংরক্ষণ করবেন। কারণ রমজানে সরকার আরও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করবে।

জানা যায়, রমজানের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে এমন আটটি পণ্যের চাহিদা বাড়ে।

সেগুলো হলো- চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর এবং শাক-সবজি। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, দেশে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে।

বিপরীতে চালের উৎপাদন হচ্ছে তিন কোটি ৭৬ লাখ টন। ১৫ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৫৯ হাজার টন। গত ৯ মার্চ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুত ১৯ লাখ ৩৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৬ লাখ ৭৬ হাজার টন, গম দুই লাখ ২০ হাজার টন এবং ধান ৩৭ হাজার টন।’

এসময় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে প্রায় ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ চার হাজার টন। আমদানি হয়েছে ছয় থেকে সাত লাখ টন।

ভোজ্যতেলের বিষয়ে সহকারী পরিচালক জানান, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। রমজানে চাহিদা আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ তিন হাজার টন। আমদানি হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টন।

এছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি প্রায় পাঁচ লাখ টন। সয়াবিন বীজ আমদানি করা হয়েছে ২৪ লাখ টন, যা থেকে চার লাখ টন অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হতে পারে। অপরিশোধিত পাম তেলের আমদানি প্রায় ১১ লাখ টন। অপরিশোধিত তেল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০ শতাংশ।

জানা গেছে, বর্তমানে  দেশে প্রায় ১৮ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে এর চাহিদা তিন লাখ টন। দেশে গত দুই মাসে চার লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। ফলে বাজারে চিনির কোনো সংকট হওয়ার শঙ্কা নেই।

একইভাবে মসুর ডাল, ছোলা, খেজুরসহ অন্যান্য পণ্যেরও কোনো ঘাটতি নেই। রমজানে মসুর ডালের চাহিদা থাকে ৭০ হাজার টন। চাহিদার বিপরীতে গত ফেব্রুয়ারি ও চলতি মার্চে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ টনের বেশি আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদার বিপরীতে এক লাখ ৭৮ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। খেজুরের চাহিদা ২৫ হাজার টন। চাহিদার বিপরীতে ৫০ হাজার টন আমদানি করেছে সরকার। একইভাবে শাক-সবজি ও আলু উৎপাদন সামগ্রিকভাবে বেড়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি।

এদিকে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হলেও বেচাকেনা তেমন নেই। এমনকি পণ্যের দাম কমলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার। ফলে সেখানে বিরাজ করছে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি। ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। বিশেষ করে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছেন আমদানিকারকরা।

আমদানিকারকরা জানান, পুরো বছর দেশে ছোলার চাহিদা থাকে প্রায় দুই থেকে দুই লাখ ১৫ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানেই কেবল চাহিদা থাকে প্রায় ৭০ হাজার টন। অথচ চলতি অর্থবছরের  প্রথম সাড়ে আট মাসেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয়েছে আড়াই লাখ টনের বেশি। রমজানে ৭০ হাজার টনের চাহিদা থাকলেও গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার টনের বেশি ছোলা আমদানি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানালেন, গত বছরের অবিক্রীত ছোলার মজুতও ছিল এবার। সব মিলিয়ে শুধু রমজানের চাহিদার দ্বিগুণ ছোলা মজুত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে ছোলাসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম।

শুধু ছোলা নয়, মটর-মসুর ডালের আমদানিও হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। তবে রমজান সামনে রেখে সে অনুপাতে গত কয়েকদিনে দেশের অন্যতম এ ভোগ্যপণ্যের বাজারে কোনো বেচাকেনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, খাতুনগঞ্জে লোকজনের আনাগোনা থাকলেও বেচাকেনা হচ্ছে না।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, খাতুনগঞ্জে গত কয়েকদিন কোনো ছোলা, ডাল, তেল, চিনির বেচাকেনা নেই। সামনে যে রমজান সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। অন্য বছর এসময় দেদারছে বিক্রি হতো। এবার সেই চিত্র নেই। সব ধরনের পণ্যের দাম প্রতিদিনই কমছে।

তিনি জানান, বর্তমানে খাতুনগঞ্জে ছোলা মানভেদে কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যা কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেশি ছিল। ছোলার মতো মটরের দামও কমেছে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি মটর ৪৭ টাকা থাকলেও সবশেষ গত বুধবার ৪৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। একইভাবে মসুর ডাল আগে ৮৯ টাকা ছিল, এখন ৮৭ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বর্তমানে খাতুনগঞ্জে খাদ্যপণ্য নিয়ে অস্থিরতা চলছে বলে জানান ব্যবসায়ীদের এই নেতা। তিনি বলেন, পণ্যের দাম হু হু করে কমছে। আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করে অস্বস্তিতে আছে। মূলত আমদানি বেশি হওয়ায় বাজারে দরপতন হচ্ছে সব ধরনের পণ্যের।

এছাড়া এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত তিন লাখ ১২ হাজার ৫৪৬ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ৪৮ দিনে আমদানি হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। এই সময়ে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৩৭ টন ১৯০ কেজি ডাল আমদানি হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি বেশি হয়েছে বলে বাজার কমছে তা কিন্তু নয়। বাজারে ডিও অনেক আছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। কারণ সারাদেশে সরকারিভাবে নজরদারি বেড়েছে। সেজন্য ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনছে না। যে কারণে বাজার কমলেও বিক্রি নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!