• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

সোনালী সম্ভাবনা পোশাকে


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১৪, ২০২২, ১০:৪৫ পিএম
সোনালী সম্ভাবনা পোশাকে

ঢাকা : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বইছে এখন বসন্তের বাতাস। একের পর এক ক্রেতা অর্ডার দিচ্ছেন। আর দামও দিচ্ছেন আগের চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে হঠাৎ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে।

বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করেছে। বলা হচ্ছে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘সোনালি সুযোগ’।

শুধু শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সংকটই নয়, সম্প্রতি চীনে আবারো বিস্তার ঘটেছে করোনার। ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা যেতে পারছেন না সেই দেশে। পাশাপাশি মিয়ানমারেও চলছে রাজনৈতিক সংকট। এই দুই দেশের অনেক ক্রেতাই মুখ ঘোরাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও পছন্দের  জায়গায় পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সুযোগ লুফে নিতে পারলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। বিশেষ করে ওই দুই দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বাজার বাংলাদেশে আসার সুবর্ণ সুযোগ দেখা দিয়েছে। যদি সত্যিই এই সুযোগ আসে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের পালে আরো হাওয়া লাগবে; পোয়াবারো হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাণিজ্যের অর্ধেকের বেশি তথা ৬ বিলিয়ন ডলার পোশাক। দেশটিতে এখন অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ জারি করেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে পারছে না।

মূলত বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতির কারণে রাজাপাকসের সরকার জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে পুরোপুরি ব্যর্থ। ফলে দেশটিতে এখন ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশছোঁয়া।

একসময়ের দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় দেশটির এই দুর্দশা কবে লাঘব হবে, অদৌ হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। এই অবস্থায় দেশটিতে স্বাভাবিক উৎপাদন কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রপ্তানি পণ্যও উৎপাদন করতে পারছে না।

এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পোশাক ক্রেতারা শ্রীলঙ্কা থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। সংকট দীর্ঘায়িত হলে দেশটির বেশিরভাগ ক্রেতাই বাংলাদেশে আসবেন বলে প্রত্যাশা করছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।

অন্যদিকে পাকিস্তানের রপ্তানি বাজার হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। দেশটির রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হলে সেখান থেকেও অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে চলে আসবেন বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।

আর মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকটের কারণে অনেক ক্রেতা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তার সুফল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভোগ করছে। ভবিষতে এই সুবিধা আরো বাড়বে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে এখন সত্যিই সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগটি ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি আরো বাড়বে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর আর পেছনে তাকাতে হবে না বলে আশার কথা শুনিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে নিট। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি করেছিলেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাত থেকে এসেছে ১৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এ খাতের রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে এখন তৈরি পোশাকের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও পছন্দের জায়গা। এমনিতেই আমরা বেশ কিছুদিন ধরে ভালো অবস্থায় ছিলাম। প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। দিন যত যাচ্ছে অর্ডার বাড়ছে; ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকেছেন। এমনটা আমরা আসলে প্রত্যাশা করিনি।

সামপ্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পাকিস্তানেও চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। মিয়ানমারে তো আগে থেকেই সমস্যা। চর্তুদিকে এসব সমস্যার সুফল বাংলাদেশে আসবে বলে আমরা আশা করছি। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার অনেক বায়ার বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন।

তিনি আরো বলেন, আগামীতে আরো অনেকেই আসবেন বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হলে সেখানকার অর্ডারও আমরা পাব বলে আশা করছি। মিয়ানমারের অনেক অর্ডার ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। এই সুযোগটা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আগামী ১০ বছর আর আমাদের পেছনে তাকাতে হবে না, তবে এ জন্য সরকারের নীতিসহায়তা খুবই প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস সংক্রান্ত যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে।

হাতেম বলেন, চীনের অনেক অর্ডারও বাংলাদেশে আসছে। দেশটিতে নতুন করে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় এখন লকডাউন চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা সে দেশে গেলে ১৪ দিনের আইসোলেশনে থাকতে হয়। সে কারণে ক্রেতারা ওই দেশে যেতে পারছেন না। আমাদের দেশে আসছেন, অর্ডার দিচ্ছেন।

ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়ও চীনের লকডাউনের প্রভাব পড়েছে। কেননা এ দুটি দেশ চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। সব মিলিয়ে সত্যিই আমরা ভালো অবস্থায় আছি। আগামী দিনগুলো আরো ভালো হবে বলে আশা করছি।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে ওভেন। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি করেছিলেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাত থেকে এসেছে ১৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

এ খাতের রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার এবং বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, পাগলের মতো অর্ডার দিচ্ছেন বায়াররা। দামও আগের চেয়ে বেশি দিচ্ছেন। প্রতি মাসেই ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ১০ বছর এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সংকটের প্রভাব বাংলাদেশে কতটুকু পড়বে, এমন প্রশ্নের উত্তরে পারভেজ বলেন, সেটা এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলা যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কার প্রধান সংকট হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার। তাদের রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তারা এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেবে রপ্তানিতে, তবে দেশটির অবস্থা এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে, তাতে খুব চেষ্টা করেও রপ্তানি বাণিজ্যের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।

আর যদি সেটা না পারে, তাহলে আমাদের জন্য মঙ্গল হবে। শ্রীলঙ্কা থেকে কোনো ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে নিলে সে বাংলাদেশে আসবে। কেননা বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের খুবই ভালো ভাবমূর্তি আমরা অর্জন করেছি। বায়াররা এখন পোশাকের অর্ডার দিলেই বাংলাদেশের কথা সবার আগে বিবেচনা করেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক মঞ্জুর হোসেন বলেন, পাকিস্তানের অবস্থা কী হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে শ্রীলঙ্কার যে অবস্থা, সেখানকার অর্ডার বাংলাদেশে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

করোনা মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে বেড়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছিল ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮১ শতাংশ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!