ঢাকা : মহামারি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা। যার প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি।
এ অবস্থায় দেশের নিম্ন ও মধ্যমআয়ের মানুষের অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সুরক্ষায় আজ বৃহস্পতিবার সংসদে উঠছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতিসহ এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ।
অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। এরপর আগামী ৩০ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাস হবে।
বাজেট ছাড়াও এই অধিবেশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিল উপস্থাপন এবং এর আগে উপস্থাপিত কিছু বিল পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সংসদে বাজেট পেশের আগে বৃহস্পতিবার (৯ জুন) দুপুর ১২টায় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর অর্থবিলে স্বাক্ষর করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
এ কারণে রাষ্ট্রপতি আজ তার সংসদ ভবন কার্যালয়ে অবস্থান করবেন। অধিবেশনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে সংসদ সচিবালয়।
রেকর্ড পরিমাণ বাজেট ঘাটতি থাকলেও তুলে ধরা হবে বিনিয়োগের উচ্চাশা এবং কাজের সুযোগ তৈরির স্বপ্ন। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় সোয়া ১৪ শতাংশ বড় বাজেট দিয়ে সংকটে পড়া অর্থনীতি চাঙা করতে চান অর্থমন্ত্রী। তার পরিকল্পনায় জনসাধারণের জন্য তেমন সুখবর না থাকলেও ব্যবসায়ীদের জন্য থাকছে নানামুখী ছাড়।
বাজেটে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে সাড়ে ৫ শতাংশের ঘরে রাখতে চায় সরকার।
বাজেটে ফ্ল্যাট কেনায় বা পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ তুলে দিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনতে দেয়া হতে পারে বিশেষ সুযোগ। আর বাজেট পরিকল্পনার বড় অংশ পরিবহন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে ঘিরে।
করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পাল্টে গেছে অনেক হিসাবনিকাশ। ফলে বাড়ছে খাদ্যপণ্য ও সেবার ব্যয়। নিত্যপণ্যের চড়া দামে দিশেহারা মানুষ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং কৃষি উপকরণের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী। এমন টানাপোড়েনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার চ্যালেঞ্জ থাকছে আগামী বাজেটে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ-গ্যাস, সার এবং খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সেও যাচ্ছে প্রণোদনা। সবমিলিযে ভর্তুকি প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ বাড়ালে ভালো হতো।
কিন্তু বললেই তো হবে না, অর্থের সংস্থানও থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কৌশল হচ্ছে এই টাকা দিয়ে একটি অবলম্বন দেয়া যে, এই টাকা দিয়ে চাল কিনে খাও আর খেয়ে কাজে বের হও। যদি এমন পর্যায়ে দেওয়া হয় যে, এটাই আয় হয়ে যায় তাহলে কাজে বের হবে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যার অনুন্নয়ন খাতেই ব্যয় হবে দুই-তৃতীয়াংশ। আর উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। গুরুত্ব পাবে কৃষি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। কিন্তু বাস্তবায়নে রয়েছে দুশ্চিন্তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. আবু ইউসুফ বলেন, কোথায় টাকাটা খরচ হচ্ছে, সেই ট্র্যাকিং পাবলিক এক্সপেনডিচার বাস্তবায়ন করা উচিত এবং প্রস্তাবিত ব্যয়ের সাথে যেন প্রকৃত ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকে।
তাছাড়া ডেভেলপমেন্ট বাজেটে ১৭-১৮শ’ প্রকল্প থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিয়ে তেরশোতে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা মনে করি, একটা গুণগত পরিবর্তন এবারের বাজেটে থাকবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি থেকে যাবে ২ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বিশাল ঘাটতি মেটাতে আগামী অর্থবছরে এই উৎস থেকে ঋণ নেবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। আর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হতে পারে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এজন্য এনবিআর’র সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছর আমাদের ঘাটতি বাজেটের যে চ্যালেঞ্জ হবে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় কিন্তু বেশি হবে। এবং ঘাটতি অর্থায়নের চ্যালেঞ্জও হবে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। সুতরাং এই বছরই জাতীয় সম্পদ আহরণের পরিমাণ কীভাবে বৃদ্ধি করতে পারি, সেদিকে নজর দেয়ার সময়।
এই বাজেটে নেয়া হচ্ছে আয় বাড়ানোর কৌশল। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ব্যাপক বিনিয়োগের পরিকল্পনাও থাকছে।
বিনিয়োগের অংক দাঁড়াতে পারে ১৪ লাখ কোটি টাকায়, যা বিদায়ী অর্থবছরের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। বেসরকারি বিনিয়োগ হতে পারে ১১ লাখ ৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা। আর সরকারি বিনিয়োগ ২ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এই বাজেটে উঁচু, নিচু, মাঝারি সবাইকেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। শিল্পায়নের ফলে উপকৃত হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাই তাদেরকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি।
তবে বাজেটের জটিল হিসাবনিকাশ বুঝতে চায় না সাধারণ মানুষ। তারা কেবল জানতে চায়, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা কাটিয়ে যাপিত জীবনকে সহনীয় করতে কী অবদান রাখবে এই বাজেট, কীভাবে প্রসারিত হবে আয়ের পথ কিংবা, সংসারের খাদ্য নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করবে এই বাজেট। আর এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করাই হবে এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য।
বর্তমান সরকারের এবারের মেয়াদে আসন্ন বাজেট এই সরকারের একটি পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট। কারণ আগামী বছরের জুনে যে বাজেট পেশ হবে, সেটি হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের।
২০২৩ সালের ১ জুলাই শুরু হওয়া এই অর্থবছর শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। এর কমপক্ষে ৬ মাস আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই বিবেচনায় বর্তমান সরকার এবারই পুরো বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে।
পরবর্তী বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে অর্ধেক। ফলে সরকার এবারের বাজেটে ব্যাপক কর্মসৃজনের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। এজন্য ধরা হয়েছে বিনিয়োগের বড় লক্ষ্যমাত্রা। নতুন জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, আগের দুটি বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা পালা করে অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। তবে এবার সংসদ সদস্যরা চাইলে প্রতি কার্যদিবসে যোগ দিতে পারবেন। সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিয়মিত স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সাংবাদিকরাও সংসদ ভবনে গিয়ে অধিবেশনের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন।
তবে সংসদ সদস্য, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে সংসদ ভবনে স্থাপিত করোনা পরীক্ষা বুথে নমুনা নেওয়া হয়েছে। যাদের করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসবে কেবল তারাই সংসদে যেতে পারবেন।
এদিকে সংসদ ভবন, সদস্য ভবনগুলো এবং সংসদ এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সংসদ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি সরবরাহ, লিফট, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সচল ও সংসদ এলাকার সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :