ঢাকা : দেশের নতুন এবং প্রথম ঐতিহাসিক স্থাপনা পদ্মা সেতু। যা গেল ২৫ জুন শুধু যোগাযোগ নয়, খুলে দিয়েছে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় স্থাপনাকে ঘিরে এখন তৈরি হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্রের সম্ভাবনা। পদ্মা সেতুর সঙ্গে দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রাও একেবারে বদলে যাবার পালা।
উদ্বোধনের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে ছুটছেন পদ্মা সেতু একনজর দেখার জন্য। ঈদে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এ জাতীয় স্থাপনাকে বেছে নিয়েছেন তারা। যেসব রেস্টুরেন্ট থেকে পদ্মা সেতু দেখা যায়, সেগুলোতে বেড়েছে ভিড়।
দর্শনার্থীরা জানান, পর্যটন সম্ভাবনা থাকায় বিনোদনমূলক অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন।
গত সোমবার ঈদের দ্বিতীয় দিনে পদ্মা সেতু দেখতে মানুষের এতটা আগ্রহ দেখা যায় যে, মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে পার হয়ে সেতুর টোল প্লাজার আগে গাড়ির চাপে তৈরি হয় প্রায় আট কিলোমিটারের যানজট। যাত্রীরা জানান, পদ্মা সেতু সারা দেশের মানুষের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই ঈদের ছুটির সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুরতে এসেছেন তারা।
একজন বলেন, আমরা পদ্মা সেতু দেখতে যাচ্ছি। এখন পদ্মা সেতুতে উঠব আমরা। খুব আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আরেকজন বলেন, সিলেট থেকে আমরা এসেছি, পদ্মা সেতু দেখতে আমরা উন্মুখ হয়ে আছি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ হচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র, খাবারের দোকান, চা-কফি শপ, খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ। পদ্মা সেতু লাগোয়া নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে আবাসিক হোটেল হক কিচেন। হোটেলটির ছাদে বসে ভ্রমণ পিপাসুরা খাবারের পাশাপাশি উপভোগ করেন পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য। হক কিচেন-এর ম্যানেজার জামাল হোসেন জানান, পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে মাওয়ায় অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। আগের চেয়ে এখন দর্শনার্থী বেশি আসে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় অতিথি বেশি আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুক্র ও শনিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ছাড়ায় ১০ হাজারের বেশি। সপ্তাহের অন্যদিনও সকাল-বিকেল সেতু এলাকায় ঘুরতে আসেন শত শত মানুষ। মাওয়া ঘাটে সারা রাত ইলিশ খাওয়ার আয়োজন তো থাকেই। এখানের দর্শনার্থী বলেন, এখানে গাড়ি রাখার আলাদা করে জায়গা নেই। সরকার যদি এখানে রিসোর্ট বা পার্কের মতো করে দিত, তাহলে এখানে আরো দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসত। উন্নয়ন হতো এই জায়গায়। রেস্টুরেন্টের মালিক জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই মানুষের আসা অনেক বেড়েছে।
মাওয়ায় পদ্মা স্কাই ভিউ রেস্টুরেন্টের মালিক হ্যাভেন হাসান মানিক বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে অনেক পর্যটক এখানে ভিড় করছে। প্রচুর গ্রাহক-দর্শনার্থী আসছে। পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনীতির নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে পদ্মা সেতু। তাই সেটিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।
এরই মধ্যে শুধু সেতু ঘুরে দেখা ও ইলিশ খাওয়াসহ এক দিনের ট্যুরের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বেশ কয়েকটি ট্যুর এজেন্সি। এ বিষয়ে ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রিয়াব) প্রেসিডেন্ট খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে মাওয়ায় আগের চেয়ে দর্শনার্থী বেড়েছে। আগে শুধু তাজা ইলিশ খেতেই এখানে আসত, কিন্তু পদ্মা সেতুর কাজ শুরু পর থেকে সেতু দেখতেও অনেকে আসেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি বুকিং পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, সেতু উদ্বোধনের পর সড়কপথে ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। ঢাকা থেকে সড়কপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেতে অনেক কম সময় লাগছে। ফলে দ্রুত সময়ে এসব অঞ্চলে পর্যটনশিল্পে গতি পাবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
শুধু যে সেতুর ওপরের প্রান্তেই জনসমাগম হয় তা নয়, নদীতে ভ্রমণ করার সুযোগও হাতছাড়া করতে চান না দর্শনার্থীরা। সেতু দেখতে অনেকেই বেছে নেন মাওয়া প্রান্তে থাকা বিভিন্ন ধরনের নৌযান। এর মধ্যে ছোট-বড় ট্রলারের পাশাপাশি স্পিডবোটও আছেই।
স্পিডবোট চালক রিফাত রহমান জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দুপুরের পর থেকে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যেহেতু সেতু দেখা যায়, সেহেতু বিকেলেই দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। তিনি আরো জানান, মাওয়া প্রান্ত থেকে শুধু সেতু দেখতেই প্রতিদিন ১০-১২টির বেশি স্পিডবোট ছেড়ে যায়। সপ্তাহের অন্যান্য দিন ২-১টা ট্রিপ পেলেও শুক্র ও শনিবার তা ১০টা থেকে ১২টা ছাড়িয়ে যায়।
কয়েকজন হকার ও খাবার বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতু দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসছেন। এ কারণে ছুটির দিনে তাদের বেচাকেনা দ্বিগুণের বেশি হচ্ছে।
মাওয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভ্রমণপিপাসু এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের যেন আন্তরিকতার কমতি নেই। আতিথেয়তার সবটুকু দিয়েই পর্যটকদের সেবা দিচ্ছেন তারা। আদি পেশা বদল করে অনেকেই মাওয়া এলাকায় পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা কিংবা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বৃহৎ পরিকল্পনা। পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই শহরের আদলে পরিকল্পিতভাবে নতুন শহর গড়ে তোলা হবে। এর সঙ্গে আবাসিক সুবিধার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি হবে শিল্পকারখানা। যার মাধ্যমে প্রায় কোটি মানুষের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। বিনিয়োগের ১৯ ভাগ রিটার্ন আসবে প্রতিবছর। এর ফলে, পদ্মা সেতুর সঙ্গে দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রাও একেবারে বদলে যাবে।
অন্যদিকে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আওতায় পদ্মানদীর জীববৈচিত্র্যের নমুনা সংগ্রহ করে তৈরি করা হচ্ছে ব্যতিক্রমী প্রাণী জাদুঘর। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের দোগাছি পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়া-১-এ চলছে প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের নমুনা সংগ্রহ। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। অচিরেই স্থায়ী ভবন নির্মাণের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মানদী ও নদীকে ঘিরে বসবাসকারী বৈচিত্র্যময় প্রাণীর নমুনার বিশাল এক সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে। কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করা হলেও প্রতিটি প্রাণীই যেন জীবন্ত অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৬ সালে পদ্মা সেতু জাদুঘর তৈরিতে প্রাণীর নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে জাদুঘরটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ।
জাদুঘরের কিউরেটর সুমন মন্ডল জানান, এক হাজার ৪১৯ প্রজাতির প্রাণীর মোট দুই হাজার ৩৫২টি নমুনা রয়েছে এই জাদুঘরে। দেশের সবচেয়ে ছোট থেকে সবচেয়ে বিরলতম মাছ রয়েছে জাদুঘরটিতে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ীর ৯২টি নমুনা, ১৭৭ প্রজাতির পাখির ৪৪০টি নমুনা, ৭৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীর ২০০টি নমুনা, ৩২৮ প্রজাতির মাছের ৩৪৩টি নমুনা, ৩০৪ প্রজাতির শামুক-ঝিনুকের ৩১১টি নমুনা, ৬৩ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়ার ৭০টি নমুনা, ২০৯ প্রজাতির পোকামাকড়ের ৩৭৩টি নমুনা, ১৮০ প্রজাতির প্রজাপতি ও মথের ২৩১টি নমুনা রয়েছে।
এছাড়া এই জাদুঘরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ৪৮ অমেরুদণ্ডী প্রাণীর ৬৬টি নমুনা, ২২টি কঙ্কাল ও দেহাবশেষ। বিভিন্ন প্রাণীর ২৫টি ডিমের, ৪৮টি বাসার নমুনাও এখানে রয়েছে। এছাড়াও ৬১ ধরনের মাছ ধরার সরঞ্জাম এবং নদীর বুকে চলা ২০ ধরনের নৌকার নমুনাও রয়েছে। পদ্মানদীতে কোন কোন প্রাণী বাস করতো। নতুন করে করে কোন কোন প্রাণী বাস করছে তার পূর্ণাঙ্গ একটি চিত্র দেখা যাবে এই জাদুঘরে।
জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. নিয়ামুল নাসের জানান, বিস্তৃত পদ্মানদী ও নদীকে ঘিরে আশপাশে শত শত প্রাণীর বাস। এসব প্রাণী-বৈচিত্র্যের ইতিহাস সংরক্ষণ ও সবার কাছে তুলে ধরার জন্যই এই জাদুঘর। তবে কোনো প্রাণীকে হত্যা নয়, মৃত প্রাণী সংগ্রহ করেই নমুনা তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাসের সংগ্রহশালার পাশপাশি শিক্ষা, গবেষণা ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এই জাদুঘর। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও আধুনিক উপায়ে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করায় সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে শতবছর পর্যন্ত টিকে থাকবে এসব নমুনা। এসব নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণ, সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বন বিভাগ ভূমিকা পালন করেছে।
অর্থনীতিবিদ আবু ইউসুফ বলেন, পদ্মা সেতু চালুর মধ্যদিয়ে শুধু যোগাযোগই নয়, খুলছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। পর্যটনের সঙ্গে নতুন নতুন শিল্প ও সেবাখাতে বিনিয়োগে পিছিয়ে থাকা জনপদে আসবে কর্মসংস্থানের জোয়ার। সংশ্লিষ্ট এলাকার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়েও কমবে দারিদ্র্যের হার। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে দেশজ উৎপাদন। কয়েক বছরে জিডিপি বাড়তে পারে দুই শতাংশ পর্যন্ত।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :