• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

ইভিএম নিয়ে দোটানায় ইসি


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ৩, ২০২২, ১২:৩৯ পিএম
ইভিএম নিয়ে দোটানায় ইসি

ঢাকা : রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের আস্থায় এনে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার নিয়ে দোটানায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ১৩টি রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে থাকলেও ২৪ টি দলই বিরোধিতা করছে।

রাজনৈতিক সংলাপের শেষ পর্যায়ে এসে খোদ নির্বাচন কমিশনও ‘ইভিএমকে একটি সংকট’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ইভিএম এবং ব্যালট উভয় পদ্ধতিতেই ভোট গ্রহণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশন কিছুটা এগোলেও রাজনৈতিক সংলাপে বিষয়টি নিয়ে বড় ধাক্কা খায় তারা। ইসির সাথে সংলাপে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ১৫টিই সরাসরি সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। সংলাপ বর্জন করা ৯টি রাজনৈতিক দলের অবস্থানও ইভিএমের বিপক্ষে। দলগুলো বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে ইভিএমের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ ১২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে।

ক্ষমতাসীন দল আগামী নির্বাচনে তিনশ আসনেই ইভিএম ব্যবহারের দাবি জানায়। তবে সংলাপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। কয়েকটি দল ইভিএম ব্যবহারের আগে ভোটের নিরাপত্তা ও ভোটারদের আস্থা অর্জনের কথা বলেছে।

আবার ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের কেউ কেউ মত দিয়েছে ইভিএমের বিপক্ষে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমে অনাপত্তি জানালেও ঘোর বিরোধিতা করেছে সংসদ নির্বাচনে এ যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে। আসন্ন গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএম হলে তারা অংশ না নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংলাপ চলাকালে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহার ও ইভিএম প্রদর্শনী করে খানিকটা ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছিল। তবে যতটা এগিয়েছিল ইসি রাজনৈতিক সংলাপের পর ততটাই পিছিয়ে দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এবং ইভিএমে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে আস্থা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

ইভিএম নিয়ে সংকটে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংলাপের শেষ দিনে গত রোববার ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ তিনশ আসনে ইভিএমে ভোট করার প্রস্তাব দেওয়ার পরই সিইসি ইভিএম নিয়ে সংকটের কথা জানান। আওয়ামী লীগ সরকারি দল হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব সিইসি তাদের অবহিত করেন।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয়ে সংকট থেকে যাবে, সেটা হলো ইভিএম। ইভিএম নিয়ে পক্ষে বেশকিছু সমর্থন পেয়েছি। আবার অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী যেন একটা আছে। ইভিএমে ভোট করে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত টার্নআউট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেককে আমরা আস্থায় আনতে পারছি না। কথাও বলেছি কিন্তু তারা বলেছে ‘না’।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেছেন, ইভিএম নিয়ে একটা সংকট থাকবে। এটার বিষয়ে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরাই নেবো সিদ্ধান্ত। তবে আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি এর ওপর পুরোপুরি ঐকমত্য নেই।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ইভিএম হলেও তা ৩০০ আসনে হওয়ার সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার মধ্যে ইভিএম হলে কোনো সমস্যা হবে না। কমিশনের কমবেশি এক’শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের যে সুযোগ আছে, সেটা কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষ-বিপক্ষের অবস্থানের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হবে কিনা, সেটা কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে বুঝা যাবে। সবেমাত্র সংলাপ শেষ হলো। দলগুলোর প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচন কমিশন বসে এই সিদ্ধান্ত নেবে। তখন ইভিএমের চ্যালেঞ্জ হবে কিনা সেটাও উঠে আসবে।

এদিকে ‘সিদ্ধান্ত নেইনি’ এবং ‘তিনশ’ আসনে ইভিএমের সক্ষমতা নই’ এ ধরনের বক্তব্য ইসি থেকে এলেও ভোটার ও রাজনৈতিক দলের কাছে ইভিএমের আস্থা অর্জনে ভেতরে-বাইরে কাজ শুরু করে তারা। এর অংশ হিসেবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলকে ইভিএম প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেয় তারা। ইভিএম প্রদর্শনীতে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও কিছু দলের ইতিবাচক মনোভাব ইসিকে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে ইভিএম পর্যবেক্ষণের পর অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিক্রিয়া ইসিকে আগ্রহী করে তোলে।

এছাড়া ইভিএমে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটিসহ অন্যান্য ভোটও ইসির আগ্রহ বাড়িয়েছে। ইসির পক্ষ থেকে ইভিএমের ভুল ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ লাখ ডলার পুরস্কার, ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ ভোটকক্ষে ডাকাত, ইভিএমে হ্যাকিং সম্ভব নয় এমন বক্তব্য আসে ইসি থেকে। ইভিএমে ভোটগ্রহণের ধীরগতি দূর করতে একটি বাটনও বাদ দেওয়ার চিন্তা হয়।

তবে কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, ইভিএমে ভোট করা বা না করা কোনোটাতেই আমরা চ্যালেঞ্জ মনে করছি না। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখার কিছু নেই। সংলাপে প্রাপ্ত তথ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত।

মতামত দেওয়া দলগুলোর অবস্থান (ওয়েট) এবং ২০১৮ পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি পর্যালোচনা করে এবং সর্বোপরি আমাদের বিবেক ও আত্মবিশ্বাস থেকে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা সঠিক সিদ্ধান্তটিই নেবো।

আমরা আমাদের বিবেক দক্ষতা জ্ঞানের আলোকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবো। আমাদের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি ভুল সেটা একটা সময় মানুষ উপলব্ধি করবে।

ইভিএম প্রসঙ্গে ওই কমিশনার আরো বলেন, আমি নিজেই ইভিএমে একাধিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ দেখেছি। সেখানে প্রার্থী ও ভোটারদের সাথে কথা বলেছি। তারা সবাই একবাক্যে ইভিএমকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্তত ব্যালটের চেয়ে ইভিএম ভালো এটা তারা স্বীকার করেছেন।

জানা গেছে আওয়ামী লীগসহ বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন বিনাবাক্যে ইভিএমের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, গণতন্ত্রী পার্টি ও এনডিএম ইভিএম ব্যবহার করতে বলেছে পেপার অডিট ট্রেইল সংযুক্ত ও শঙ্কা কাটিয়ে।

ইভিএমের ঘোর বিরোধিতা করেছে জাতীয় পার্টি। এ মেশিন ব্যবহার করলে আসন্ন গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে দলটি অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে।

এ দলটি ছাড়াও বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জাকের পার্টি, গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএমের বিরোধিতা করেছে।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ইভিএম প্রদর্শনীর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কেউ কেউ (রাজনৈতিক দলের) বিরোধিতা করছেন, কেউ কেউ পক্ষে আছেন, কেউ কেউ পক্ষে এসেছেন মোডিফিকেশন করার পরে।

তিনি বলেন, ব্যালট পেপার ও ইভিএমের মধ্যে তুলনা করলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ইভিএম এগিয়ে থাকবে। ইভিএমে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না।

যদিও সিইসি জাকের পার্টির সঙ্গে সংলাপে বলেছিলেন, আমরা ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। কিন্তু হ্যাকিংটা সম্ভব নয়। হ্যাকিংটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, এটি স্ট্যান্ড অ্যালোন সিস্টেম, এটি ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এটাকে বহুভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পরীক্ষা করে যাচ্ছি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!