• ঢাকা
  • শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১
সিরিজ বোমা হামলার ১৭ বছর আজ

জঙ্গি অর্থায়নে কারা ছিল, এখনও অজানা


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ১৭, ২০২২, ০১:৪২ পিএম
জঙ্গি অর্থায়নে কারা ছিল, এখনও অজানা

ফাইল ছবি

ঢাকা : সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার ১৭ বছরপূর্তি আজ। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলার ৪ শতাধিক স্পটে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আত্মপ্রকাশ ঘটে।

ওই সময় পুলিশ ও র‌্যাব সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জেএমবির সহস্রাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে। ফাঁসি কার্যকর করা হয় সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের। তারপরও থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা।

এভাবেই নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়ে আলোচনায় আসে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি। গোপনে সংগঠিত হওয়া জঙ্গিদের শক্তি, একযোগে হামলার সক্ষমতায় নড়েচড়ে বসেছিল আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।

তার ১১ বছর পর জঙ্গিরা তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটায় গুলশান হামলার মধ্য দিয়ে। সেই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়।

এরপর সাঁড়াশি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের ‘মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার’ দাবি করলেও অনলাইনে সংগঠিত হয়ে উগ্রবাদিদের ফিরে আসার চেষ্টা থেমে নেই।

১৭ অগাস্টের হামলায় দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সে সময় দায়ের করা ১৫৯টি মামলার মধ্যে ঢাকায় চারটিসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে ৪১টি মামলা এখনও বিচারাধীন।

সে সময়ে বলা হয়েছিল, শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ জেএমবির সুরা কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই হামলা চালানো হয়েছিল। পরিকল্পনাকারী হিসেবে শায়খ রহমান, বাংলাভাই ও তাদের অন্যান্য সহযোগীদের নাম বলা হয়েছিল।

কিন্তু তাদের অর্থ দিয়েছিল কারা, তাদের এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি বলে জানাচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) কামরুজ্জামান বলেন দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর থানা পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করে। হামলার পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের সবার নাম পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এখনো আমরা কাজ করছি। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্র্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে অনেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সাজা হয়েছে। সিরিজ বোমা হামলায় যেসব জঙ্গি এখনো আত্মগোপনে আছে তাদের ধরতে বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত আছে।

২০০১ সালে আফগানফেরত মুজাহিদ শায়খ রহমানের নেতৃত্বে জন্ম জেএমবির। ২০০৪ সালের দিকে এতে যোগ দেন সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানিসহ অনেকে।

সে সময় রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে নৃশংস কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ‘সর্বহারা নিধন’ শুরু হলে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

নিষিদ্ধ ঘোষণার পরই জেএমবি মরিয়া হয়ে উঠে এবং ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয়।

ওই ঘটনার পর সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানসহ ৪৫৫ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যার দায়ে শায়খ রহমান ও বাংলাভাইসহ আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।

২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে শায়খ রহমান, বাংলাভাই, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু জানান, ১৭ অগাস্টের হামলার পর ঢাকায় পাঁচটি মামলা হয়েছিল,তার মধ্যে চারটি মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি।

বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও সাক্ষীরা না আসায় এসব মামলার নিস্পত্তি করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

গুলশান হামলা মামলা অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ নেতৃত্ব ছেঁটে ফেলার পর জেএমবি কিছুটা দুর্বল হলেও বন্ধ হয়নি সাংগঠনিক তৎপরতা। ওই সময় সংগঠনের দায়িত্ব নেন সাইদুর রহমান।

২০১০ সালে সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হলে ‘ডাক্তার’ নজরুল অঘোষিত নেতা হিসেবে সংগঠনের মূল দায়িত্বপালন শুরু করে। কিন্তু নজরুলের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি জেলে থাকা সাইদুর।

ওই সময় বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকায় জেএমবির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। স্পষ্ট হয়ে উঠে কারাগারে থাকা সাইদুর রহমান, সালাউদ্দিন সালেহীন এবং বাইরে থাকা নজরুল, সারোয়ার জাহান (আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত) পক্ষের বিরোধ। ২০১৩ সালের শেষে দিকে দিনাজপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় নজরুল নিহত হন।

সাংগঠনিক কোন্দলের মধ্যে নিজের দল ভারী করতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরোয়ার জাহানের নির্দেশে ‘অ্যাডভোকেট’ ফারুকের (ফারুক হোসেন ওরফে জামাই ফারুক, যিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হন। সেখানে তার নাম বলা হচ্ছে আনোয়ার হোসেন ফারুক) নেতৃত্বে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন, রাকিবুল হাসান (পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত) ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা।

কিন্তু দল বিভক্ত হওয়ার কারণে আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লে শুধু উত্তরাঞ্চলে জেএমবির তৎপরতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় সরোয়ার জাহান এবং তার সহযোগী মামুনুর রশিদ রিপন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করে এবং তারই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাজক, পুরোহিত, মাজারের খাদেম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করতে শুরু করে বলে হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়।

ওই সময়ই আবির্ভাব ঘটে তামিম আহমেদ চৌধুরীর (২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে অভিযানে নিহত)। কানাডার পাসপোর্টধারী তামিম ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশেঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।

তদন্তকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মে মাসের দিকে তামিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেএমবির একাংশের নেতৃত্ব দেওয়া সরোয়ার জাহান, মামুনুর রশীদ রিপন ও অন্যরা একত্রিত হয়ে ‘আইএসের ভাবধারায় জিহাদ’ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

তামিম-সারোয়ারের নেতৃত্বেই পরে প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের নিয়ে গঠন করা ‘নব্য জেএমবি’। তাদের পরিকল্পনায় ২০১৬ সালের গুলশান হামলা বাংলাদেশের দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে দেয়।

এদেকে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতার সুযোগ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। যারা হিজরত (জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বাড়ি ছাড়ছে) করছে তাদের মধ্যে প্রতি মাসেই এক-দুজন ধরা পড়ছে।

তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিরা এখন বিভিন্ন অনলাইন সাইটের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন সাইটে লোন অফ (এককভাবে) হামলার প্রচারণা চালাচ্ছে। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এটিবি) প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়াসহ (চাকরিচ্যুত মেজর) পলাতক জঙ্গিরা। তিনি দেশে নাকি বিদেশে আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়। সব মামলারই তদন্ত শেষ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ১০২টি মামলায় রায় হয়েছে। ৪১টি মামলা তদন্তাধীন। ১৬টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। মামলাগুলোতে আসামির সংখ্যা ছিল ৮৩০ জন। এদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৬০ জনকে। বিভিন্ন মামলায় খালাস পেয়েছেন ৩৫৮ জন। তদন্ত শেষে ৭৩৮ জনের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৩৩৯ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে পলাতক জামিন পেয়েছেন ১৩৩ জন। জামিনের পর পলাতক আছেন ৫০ জন। ফাঁসির দণ্ড হয়েছে ১৫ জনের।

আজ সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ : দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। বুধবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয়ভাবে এ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। বিক্ষোভ মিছিলটি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে মৎস্য ভবন-কদম ফোয়ারা-প্রেস ক্লাব ও জিরো পয়েন্ট হয়ে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!