• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
পরিবেশের প্রাণ যায় যায়

রোগব্যাধি মৃত্যু সবই বাড়ছে


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৫, ২০২৩, ১১:৪৪ এএম
রোগব্যাধি মৃত্যু সবই বাড়ছে

ঢাকা : আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে শামিল হই সকলে’; আর স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’।

এদিকে বর্তমানে দেশে মোট মৃত্যুর ৩২ শতাংশই ঘটছে পরিবেশ দূষণজনিত নানা অসুখবিসুখের কারণে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত চার বছরে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৪ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপে এই হার ১১ দশমিক ৫ শতাংশ আর ভারতে ২৬ দশমিক ৫।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণের কারণে নানা অসুখবিসুখের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষে রয়েছে ভারত।

এসব দূষণের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে বায়ুদূষণ। দেশে বছরে বায়ুদূষণজনিত রোগের কারণে সর্বনিম্ন ৮০ হাজার থেকে ৮৩ হাজার ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে বর্জ্য ও বায়ুদূষণ মিলে বছরে এই মৃত্যু ২ লাখ।

বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এবং দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পরিবেশের নানা ধরনের দূষণের মধ্যে সাত ধরনের দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। এগুলো হলো বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, নদীদূষণ ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনা। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষের মধ্যেও নানা ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে।

এমন অবস্থাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণ বেড়ে যাওয়ায় অসংক্রামক রোগ ৭০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। পরিবেশ দূষিত হলে অনিবার্যভাবে মানুষ প্রভাবিত হয়। মানুষের রোগ বেড়ে যায়। উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। নদী, সমুদ্রের পানি দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ কমাতে হলে পরিবেশ দূষণের উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পরিবেশ দূষণের কারণে দেশের জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন ও সন্তোষজনক অবস্থায় নেই।

বিশেষ করে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ এগুলো আমাদের খুবই ভাবিয়ে তুলছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের ৪-৫ বছরের গড় আয়ু কমছে। দূষণমুক্ত পরিবেশ থাকলে আমরা সুস্থ থাকব, গড় আয়ু বাড়বে। কর্মক্ষমতা ও কর্মঘণ্টা বাড়বে। বেশি উৎপাদন হবে।

দূষণে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ : এ বছরের মার্চে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে অপরিণত শিশু প্রসব এবং কম ওজন নিয়ে শিশু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ।

অর্থাৎ বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার ১৬ পয়েন্ট বেশি। অন্যদিকে কোনো শিশুর জন্ম মায়ের গর্ভধারণের ২৫৯ দিনের আগে হলে তা অপরিণত বা প্রিম্যাচিউর শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়।

এ ছাড়া বায়ুদূষণে মানুষ শ্বাসনালির বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা, গর্ভবতী মায়েদের ওপর প্রভাব, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়া ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বেশি রোগ-মৃত্যু বায়ুদূষণে : নানা ধরনের পরিবেশ দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণের কারণেই সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। গত ২৮ মার্চ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০ শতাংশ অকালমৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ।

আর সে বছরের ১৮ মে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে বলা হয়েছে, বিষাক্ত বায়ু ও বর্জ্যরে দূষণের কারণে দেশে প্রতি বছর দুই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর সর্বনিম্ন ৮০ হাজার থেকে ৮৩ হাজার ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ মারা যায়।

ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জন মারা যান। দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ পানিদূষণ। প্রতি বছর পানিদূষণে ৩০ হাজার ৮৭৪ জনের প্রাণহানি হয়।

এ ছাড়া অন্যান্য দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিসাদূষণ। সিসাদূষণের কারণে দেশে ৩০ হাজার ৭৭৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পেশাগত দূষণে মারা যান ১০ হাজার ২৮৯ জন।

এ ছাড়া অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্লাস্টিক দূষণের কারণেও মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্য। এসব বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি।

এ ছাড়া প্লাস্টিক দূষণের কারণে মানুষ থাইরয়েড, হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণ, কিডনি রোগ, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে রোগ বাড়ছে: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. আতিকুল হক বলেন, গত বছর সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, কক্সবাজারসহ উপকূলবর্তী অঞ্চলে একটা গবেষণা শেষ করেছি। সেখানে পানির লবণাক্ততা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। সাধারণ এলাকার তুলনায় লবণাক্ত এলাকার মানুষের মধ্যে বেশি উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে চর্বি বেশি পেয়েছি। এই সংখ্যা দেশের মোট অংশের আক্রান্তের চেয়ে অনেক বেশি।

এ ছাড়া কিডনি ও পাইলস রোগ খুব বেশি। লবণাক্ত পানির কারণে তারা এসব রোগে ভুগছে। সেখানে সুপেয় পানির মারাত্মক অভাব। তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!