ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি নিকটে বলা যায়। ঈদুল আজহার পরই রাজনীতির ময়দানে শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনের আমেজ। উত্তপ্ত হয়ে উঠবে রাজপথ। নির্বাচনকে সামনে রেখে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। সেই চ্যালেঞ্জে নতুন যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি।
দীর্ঘদিন টানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তাদের আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর। এছাড়া নির্বাচনি বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে দলটিকে।
অন্যদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার সফলতার বিকল্প ভাবছে না বিএনপি। আন্দোলনের মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা তাদের সরচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা তৈরি করেছে দলটি। শিগগিরই সরকার পতনের একদফায় রাজপথে নামার প্রস্তুতি চলছে।
আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা বিএনপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মামলা-হামলা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিত করা, সহিংসতা এড়িয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কী হবে-সেসব দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন হাইকমান্ড।
বিএনপি চাচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আসন ভাগাভাগি, যোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠন। তবে কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে দলটি নতুন করে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রতিহত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপরও সরকার যেনতেন নির্বাচন করে উতরে গেলে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপিকে টিকিয়ে রাখাই হবে তখন তাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যোগ্য প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরি, অপপ্রচারের জবাব ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের। এছাড়া গাজীপুরের ভোটের পর আসন্ন চার সিটির নির্বাচনও ভাবনায় ফেলেছে দলের হাইকমান্ডকে। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেও দলটি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেছেন-তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
গণভবনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আগামী নির্বাচনটা চ্যালেঞ্জের হবে বলে জানান দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নির্বাচনটা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ নানা ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়ে দলটির প্রধান বলেন, আমাদের সংগঠনটা যথেষ্ট শক্তিশালী। সংগঠনটা যেন আরও মজবুত থাকে। সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণের কষ্ট লাঘবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি মূল্যস্ফীতি ও লোডশেডিংয়ে মানুষ কষ্টে আছে। স্বীকার করে বসে থাকলে তো হবে না। নানা কৌশল দিয়ে এটি মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্যই হবে মূল্যস্ফীতি যেন আর না বাড়ে সেটি নিশ্চিতে কাজ করা।
অন্যদিকে মঙ্গলবার (৬ জুন) ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, তার দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।পিটার হাসকে ফখরুল জানান যে, এ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেছেন, শুধু বিএনপি নয় জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি।
বিএনপির আরও কয়েক নেতা সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত থাকে। আদর্শের চেয়ে তাৎক্ষণিক চাওয়া-পাওয়াই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। তাই আন্দোলনে সফলতা আদায়ে সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন।
সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপির মধ্যে ঐক্য ও চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করাও হাইকমান্ডের দায়িত্ব। কারণ, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে সবকিছু হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতাদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দলটির নেতারা মনে করেন, চূড়ান্ত আন্দোলন নস্যাতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। অতীতের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে দল বেশ শক্তিশালী। নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে দেওয়া হতে পারে নতুন মামলা। আবার পুরোনো মামলাগুলোও সচল করা হতে পারে। অনেক নেতাকে টার্গেট করে তাদের মামলা দ্রুত শেষ করে দেওয়া হতে পারে সাজা। তাই মামলা ও সাজা মোকাবিলা করে রাজপথে টিকে থাকাও কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।
নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করাও আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
একই সঙ্গে আন্দোলনের নামে বা আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় ক্ষমতাসীন দল হিসাবে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশিদের এবারের সক্রিয়তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যদিও আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণা রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং বিএনপির নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এখন দুর্বল হয়ে যাবে। এখন বর্তমান সরকারের অধীনেই তাদের ভোটে আসতে হবে। তবে একই সঙ্গে পাশাপাশি ভিসানীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি অনুযায়ী স্যাংশন যাতে না আসে সেই পথও খুঁজছে দলটি।
তাছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ততই বাড়ছে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ছাড়াও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম ও হত্যা, গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে অহরহ। কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে সফর বৃদ্ধি, ঢাকায় ডেকে মীমাংসা করাসহ নানা উদ্যোগ থাকলেও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। দলের অব্যাহত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীনরা।
একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে এ অবস্থা বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে স্থানীয় সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারাকেও দাবি করছেন অনেকে। এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। কারণ ভোটের আগে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠতে পারে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য। ইতোমধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের অভাবনীয় মাইলফলকও অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে গত শীতের আগে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছিল এবং ব্যাপকভাবে লোডশেডিং হচ্ছিল। শীতের মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সম্প্রতি আবার বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। যাতে তীব্র সমালোচনা মুখে পড়ছে আওয়ামী লীগ। লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই অর্জন ম্লান হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জ রয়েছে আওয়ামী লীগের সামনে। এবার নির্বাচন অতীতের চেয়ে কঠিন হবে। ফলে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে আসতে পারে এমন প্রার্থীদেরই বেছে নিতে হবে দলটিকে। এছাড়া দলের নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করবেন এমন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন বিভিন্ন সংস্থার জরিপসহ নানা মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসব বিষয় মনিটরিং করছেন। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রচারণা শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের।
সোনালীনিউজ/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :