ঢাকা : চাকরি জীবনে ভালো পোস্টিং ও পদোন্নতি পেতে গত এক যুগ ধরে নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের আদর্শের কর্মী হিসেবে জাহির করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে সেই প্রতিযোগিতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তারা এখন রাজনৈতিক নেতাদের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৌকার পক্ষে ভোটও চাচ্ছেন। সম্ভব্য প্রার্থীরা তাদের জয় নিশ্চিত করতে পছন্দের কর্মচারীদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় পদায়ন করছেন।
সম্প্রতি একটি থানার ওসির ফাঁস হওয়া অডিওতে এ ঘটনার সত্যতাও মিলেছে। যদিও সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি মালায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিষেধ রয়েছে। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সুশীল সমাজের মধ্যে চলছে আলোচনা সমালোচনা। এ সব ঘটনায় সরকার অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বদলি করেই দায় সারছেন।
গত শনিবার রাজশাহীর চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমের এক অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া আর কারো কথা শুনি না। চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেয়ার কারণে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একজন পরিদর্শকের সমালোচনা করেন ওসি।
তিনি বলেন, আমাকে দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির আতিককে বদলি করে দেবো। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে রাজশাহীতে। এর আগে গত সোমবার সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করা আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার’ বলে মন্তব্য করেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো: ইমরান আহমেদ।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে জামালপুরের ডিসিকে বলতে শোনা যায়, ‘যে সরকার এই উন্নয়ন করেছে, এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সেই সরকারকে আবার নির্বাচিত করে, আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার। আমি এটা মনে করি। আপনারা নিজের চোখে দেখে সরকারের প্রতি অকৃতজ্ঞতা করবেন না।’
এর পরের দিন এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, নির্বাচন সামনে নিয়ে এখন একজন ডিসি এমন কথা বলতে পারেন না। তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে পাঠানো হয়। তবে কেউ বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে কি না তাও যাচাই করা হবে। পরে সুশীল সমাজের সমালোচনার মুখে তাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদে বদলি করা হয়। জামালপুরের জেলা প্রশাসক ইমরান আহমেদের আগে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত ১৫ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিজের দল উল্লেখ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চান জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর। পরে তাকে পুলিশ লাইন্সে প্রত্যাহার করা হয়। একই দিন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পক্ষে ভোট চান সেখানকার ওসি ফারুক আহমেদ।
তার বক্তব্য ছিল, ‘নাঙ্গলকোটের মানুষ গণহারে উনাকে (আ হ ম মুস্তফা কামাল) আবার নির্বাচিত করবেন। এটা আমার দিক থেকে আপনাদের কাছে মিনতি। আসলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নাঙ্গলকোটের এত উন্নয়ন করেছেন।
নাঙ্গলকোটের অনেক এলাকায় রাস্তাঘাট ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না। উনি যখন এলেন, তখন আপনাদের মন জয় করলেন এবং আপনাদের উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিলেন। এমন বক্তব্যের পর ওই ওসিকেও পুলিশ লাইন্সে প্রত্যাহার করা হয়।
অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২৫ এর উপবিধি-১ স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোন সরকারি কর্মচারী কোন রাজনৈতিক দলের বা, রাজনৈতিক দলের কোন অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হইতে অথবা অন্য কোনভাবে উহার সহিত যুক্ত হইতে পারিবেন না, অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করিতে বা কোন প্রকারেই সহায়তা করিতে পারিবেন না।’
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মুখ ফসকে দুই-একটি কথা বের করে ফেলছেন। অন্যরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করতে প্রস্তুত। এর আগের নির্বাচনগুলোতেও সেটির প্রমাণ মিলেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে রেখেছিল। তারাই নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ধরনের কর্মকর্তাদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফলাফল প্রকাশ করেন তারা। নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে থাকেন। ফলে তারা শতভাগ নিরপেক্ষ না থাকলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৫, ২৪ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ৩৫ ও ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ইউএনওর দায়িত্বে থাকবেন। এই দুই ব্যাচ বর্তমান সরকারের সময়েই নিয়োগপ্রাপ্ত।
ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন এমন কর্মকর্তারা ডিসি হয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে বর্তমানে বিসিএস (পুলিশ) ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এমটিআই