ঢাকা : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনমনীয় অবস্থা থেকে নমনীয় করতে নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছে মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। পর্যবেক্ষক দলটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। এর বাইরেও মার্কিন ভিসানীতিসহ নানা ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ রয়েছে।
এসব উদ্যোগে কী প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের যে কঠোর মনোভাব সেখান থেকে বরফ গলবে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরাও এমন প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলছেন, সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, এখনও অনমনীয় তারা। সমঝোতার কোন লক্ষন নেই।
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের নেতারা বলছেন, তাদের আলোচনার দরজা খোলা। আলোচনা না হওয়ার জন্য তারা একে অপরকে দূষছেন এবং নিজেদের কঠোর মনোভাবের কথাই বলছেন। ফলে এই মুহূর্তে সংকটের সমাধানের কোন পথ দেখা যাচ্ছে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরাই চাই সংলাপ হোক। রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসুক। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের মনের মধ্যে কী আছে সেটা তো আর আমরা জানি না। ফলে আমরা আশা করতে পারি, ধারণা করতে পারি মাত্র। এর বাইরে আমাদের তো কিছু করার নেই৷’
বাংলাদেশ সফরত মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করবে তারা। সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল এবং তাদের সহায়তাকারীরা ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে।
বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল কমিশনের ভূমিকা, দায়িত্ব ও কার্যক্রমসহ অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। আমরা সবকিছু তাদের বোঝাতে পেরেছি। তাদের মূল ফোকাস ছিল অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তারা এরমধ্যে বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও সরকারি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এটা প্রি এসেসমেন্ট টিম বলে। ওরা কী করবে আমরা জানি না। তারা যা যা জানতে চেয়েছিলেন, তারা জেনেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের একটা আবহ হয়ত তৈরি হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে বরফ গলবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে মূল কাজটা করতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তির। এটা অন্য কেউ করে দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সে কারণে এই তৎপরতাকে আমি নেতিবাচকভাবে দেখি না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই তৎপরতার মধ্যে কাউকে ক্ষমতায় ওঠানো বা নামানোর বিষয়টি না ঘটে এবং (তা) যদি হয় সুষ্ঠু স্বাভাবিক নির্বাচনের জন্য তাহলে তো ভালো কথা।
সংবিধানের মধ্যে থেকে ভালো নির্বাচনের ব্যাপারে নানা ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, আরও হতে পারে৷ সহিংসতার দিকে না গেলেই ভালো। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো বোঝাপড়ারভিত্তিতে একটা সমাধান হতে পারে।’
মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ওবায়দুল কাদের। বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে, আমাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে৷ নির্বাচনের পরিবেশ এবং বাস্তব অবস্থা, কোনো ভায়োলেন্সের আশঙ্কা আছে কি না৷ এসব বিষয় তারা পর্যবেক্ষণ করছেন।
প্রতিনিধি দল কোনো প্রস্তাব দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা কোনো প্রস্তাব দেয়নি, আলোচনায় উঠে এসেছে বিএনপির দাবি। তারা কথায় কথায় বলেছে আপনাদের মধ্যে এখনো কোনো সমঝোতার পথ খোলা আছে কি না! তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমন্বয়ের কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না! আমরা বলেছি বিএনপিই সেই পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
তাহলে কী সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গেছে? জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘আমাদের দরজা তো সব সময়ই খোলা; কিন্তু তারা যেটা বলছে, সরকারকে ফেলে দেবো, নির্বাচন বন্ধ করে দেবো, শেখ হাসিনাকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাবে এই ধরনের কথা বললে তো আর আলোচনার জায়গা থাকে না। আমরা সবাই চায়, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই পথে তো তারা যাচ্ছে না। তারা সহিংসতার ভয় দেখায়? আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। এই দলটি নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখানে এসেছে৷ ফলে সংলাপ হতে হলে আগে তাদের নমনীয় হতে হবে।’
একইভাবে পর্যবেক্ষক দলটি বিএনপির সঙ্গেও বৈঠক করেছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দেশে এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই এই বক্তব্য এবং এর পক্ষে তারা তাদের যুক্তি তুলে ধরেছেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও বর্তমান সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তারা তুলে ধরেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু দেশের মধ্যে নয়, সারা বিশ্বেই প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায়, সারা বিশ্বও একইভাবে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায়। শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা ভোট চুরির একটি প্রকল্প নিয়েছে, যেটিকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে শেখ হাসিনার অধীনে যে নির্বাচন হবে, সেটি বাতিল করতে হবে।
নানা ধরনের উদ্যোগের কারণে সংলাপের ব্যাপারে কী বিএনপি আগ্রহী? জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের তো আলোচনা করতে কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যা বলে তারপর তো কোন আলোচনা চলে না৷
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, এই দাবি মেনে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে? তাহলে আর আলোচনার দরকার কি? সরকারই আলোচনার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। তবে সরকার যে চাপে আছে সেটা আমরা বুঝতে পারি; কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা এখনও কথার বেলায় নমনীয় নয়৷ ফলে তারাই একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।’
প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদেরও বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা আছে।
বিএনপি নির্বাচন করবে না, তারা আন্দোলন করবে- সেখানে সহিংসতা হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় এসব বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাচ্ছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তা ফেয়ার বা আন ফেয়ার হলো তা বোঝা যায় না।
আমরা নির্বাচনে যাব না, এমন সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে, আমরা পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সামনের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেব।
কূটনীতিকদের এমন তৎপরতায় প্রধান দুই দল কি নমনীয় হবে? জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ফজলুল হালিম রানা বলেন, ‘এখন তো আর দুই পক্ষ না, তিন পক্ষ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা একটা পক্ষ৷
আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে এখনও নমনীয় হওয়ার কোন লক্ষন আমি দেখছি না। পাশাপাশি তৃতীয় যে পক্ষটি তাদেরও নমনীয় হওয়ার কোন লক্ষন নেই। সব মিলিয়ে যে যার অবস্থানে অনড় রয়েছে৷ এই অবস্থায় সমঝোতার কোন ইঙ্গিত এখনও মিলছে না।’ সূত্র : ডয়চে ভেলে
এমটিআই