ঢাকা : আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ধারণা করা হচ্ছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তার আগেই বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
দলের নেতারা বলছেন, দুর্গাপূজা শেষ হওয়ার পরই তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন। তার আগে আগামী ১৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির যে সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে সেখান থেকে সরকারের জন্য সংক্ষিপ্ত ‘আখেরি’ আলটিমেটাম দেওয়া হতে পারে।
তফসিলের আগে আন্দোলন নিয়ে কোন পথে বিএনপি? এ শিরোনামে মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
প্রতিবেদনে বিএনপি নেতাদের বরাতে বলা হয়, এখন থেকে তাদের আন্দোলন হবে মূলত রাজধানী ঢাকামুখী।
দুর্গাপূজার আগে বিএনপির সবশেষ কর্মসূচি ছিল বুধবার (১৮ অক্টোবর)। এদিন সরকারের পদত্যাগসহ একদফা দাবিতে ঢাকায় জনসমাবেশ করবে দলটি। তবে এ জনসমাবেশ একেবারেই ঢাকা এবং এর আশপাশের শহরগুলোর জন্য বলে জানা গেছে।
ময়মনসিংহ জেলার বিএনপি নেতা আজিজুল হাকিম আজিজ বলেন, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচির জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। দলের পক্ষ থেকে যেকোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে তারা প্রস্তুত রয়েছেন। হয় সেটা ঢাকামুখী আন্দোলন হোক কিংবা বিভাগীয় কর্মসূচি।
বিএনপির সমাবেশগুলো থেকে কী ধরনের নির্দেশনা আসে, সেটা দেখার জন্যই তারা এখন অপেক্ষা করছেন।
দলের কর্মীরা ধারণা করছেন, দুর্গাপূজার পর বিএনপির কর্মসূচি থেকে সরকারবিরোধী বড় ধরনের কর্মসূচি আসবে। তার মাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করে তোলা হবে। তারা এখন সেই সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছেন।
পাশাপাশি সমমনা বা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বিএনপি। গত কয়েকদিনে এসব দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে তখন তাদেরও পাশে পেতে চাইছে দলটি।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, নভেম্বর মাসেই দ্বাদশ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার কথা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নভেম্বর মাঝামাঝি সময়ে তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে হলে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। কারণ এ পর্যন্ত তাদের করা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তাদের অবস্থান থেকে নড়াতে পারেনি দলটি।
ঢাকামুখী কর্মসূচি কেন : বিএনপির নেতারা বলছেন, ১৮ অক্টোবর বিএনপির জনসমাবেশ থেকে সরকারকে কোনো একটা আলটিমেটাম বা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে। সেটা কার্যকর না হলে বড় আন্দোলনের পথে হাঁটবে বিএনপি।
সমাবেশের আগে বিএনপির বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতা তাদের কৌশল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে মুখ খুলতে চাননি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, এ জনসমাবেশ থেকে হয়তো সরকারকে কোনো একটি বিষয়ে একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে।
দুর্গাপূজা শেষে আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের কথা ভাবছে বলে সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে।
সেসময়ে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে যা থাকতে পারে সে বিষয়ে আলাল হোসেন বলেন, বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচি ঢাকামুখী হবে।
কারণ হিসেবে তারা দাবি করেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। শক্তি প্রয়োগ করে এগুলো সবই সরকারের পক্ষে ব্যবহার করা হবে। আর বিএনপি সেটিকেই রুখে দিতে চাইছে।
ঢাকামুখী কর্মসূচির মধ্যে যেসব বিষয় থাকতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে অবস্থান কর্মসূচি, ঘেরাও কর্মসূচি ইত্যাদি। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণের ওপর ভিত্তি করে এর চেয়েও কঠোর কোনো পদক্ষেপ হতে পারে বলেও জানান তিনি।
বিএনপির দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ধরনের আভাস দেখা যায়নি। বরং আওয়ামী লীগ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি তাদের দাবি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, রাজনীতি কোনো মল্লযুদ্ধ না যে সরকার পাত্তা দিচ্ছে না, আমরা গিয়ে সরকারের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এমন দল বিএনপি না।
তিনি বলেন, আমাদের মানুষের কাছে যেতে হবে এবং মানুষকে নিয়েই কথা বলতে হবে, তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করুক আর যাই করুক।
আন্দোলন শুরুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত বিএনপির ২২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই তাদের কাজ করতে হয়; যার মধ্যে বিভিন্ন রকম কৌশল ও বক্তব্য থাকে।
তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে বিএনপি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণা মানেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া নয়। দুই ঘটনার মধ্যে অনেক সময়ের ব্যবধান থাকে।
তবে সরকার যদি বিএনপির দাবি না মেনে একতরফাভাবে নির্বাচন ঘোষণা করে তাহলে বিএনপি সর্বশক্তি নিয়েই তা প্রতিহত করবে বলেও জানান তিনি।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যদি এরকমটা তারা ঘোষণা করে একতরফা শিডিউল, তারপরে আমরা আমাদের যা করার আমরা সর্বশক্তি নিয়েই সেটা করব। কোনো সন্দেহ নেই।
বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ মাঠেও থাকবে বলে দলের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে থাকা অনেক পুরোনো মামলা সচল করা হয়েছে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ : চলতি বছরের ২ আগস্ট ঢাকায় থাকা ২৫টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। সেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে বিএনপি নেতারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বলে জানানো হয়েছিল।
একই সঙ্গে ওই বৈঠককে ‘ব্রিফিং’ হিসেবে উল্লেখ করে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কূটনীতিকদের জানাতে নিয়মিত এই ‘ব্রিফিং’ করবে তারা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় এসেছিল তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে বিএনপি। সেখানে বিএনপি মার্কিন দলটিকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
ওই বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তারা নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহীউদ্দিন আহমদ বলেন, আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের অবস্থানটা বিএনপিকে কিছুটা শক্তি যোগালেও তারা নির্বাচনের বাইরে গিয়ে কোনো পরামর্শ দেবে না। বিভিন্ন দেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য দিলেও বিএনপি যে দাবিতে আন্দোলন করছে, সেই নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কোনো বক্তব্য আসেনি।
সুতরাং এটা বিএনপির আন্দোলনের জন্য একটা সংকট বলে মনে করেন মহীউদ্দিন আহমদ।
তবে বিএনপির নেতারা আশা করছেন, জোরালো আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের সেই দাবির প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
এমটিআই