ঢাকা : সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি সমমনা দলের ডাকা তৃতীয় দফার অবরোধ শুরু হয়েছে বুধবার (৮ নভেম্বর) ভোর ছয়টা থেকে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে মাঝপথেই পণ্ড হয় যায় বিএনপির সমাবেশ। সমাবেশ বানচালের প্রতিবাদে পরের দিন (২৯ অক্টোবর) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা বিএনপি হরতাল পালন করে। এক দিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয়।
এরপর রোববার (৫ নভেম্বর) ভোর ৬টা থেকে ২ দিন সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও সমমান বিরোধী দলগুলো। এসব কর্মসূচি চলাকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর গ্রেপ্তারের বাইরে থাকা নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন।
এদিকে, আগামী সপ্তাহে দেশব্যাপী লাগাতার কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই লাগাতার কর্মসূচি কঠোরভাবে পালিত হবে। এর আওতায় দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ অথবা অবরোধ ও হরতাল একই সঙ্গে পালনের কথা রয়েছে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে ইতোমধ্যে সব সাংগঠনিক জেলায় বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা কোন কৌশলে কীভাবে মাঠে থাকবেন, এ বিষয়ে দেওয়া হয়েছে দিকনির্দেশনা।
জানা গেছে, মাঠের নেতাকর্মীদের পরিস্থিতি মূল্যায়নের পাশাপাশি গ্রেপ্তার এড়িয়ে কর্মসূচি সফলের জন্য বলা হয়েছে। এদিকে সমমনাদের বাইরে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে লাগাতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে আলোচনা চলছে। বিএনপি হাইকমান্ড তাদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেছেন। ১২ নভেম্বরের মধ্যে তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। দুপক্ষের অনমনীয় অবস্থানই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখনো সময় আছে আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধানের। জনগণ ও দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। সহিংসতা রোধের বিকল্প শুধু সংলাপ। কাজেই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে তারা আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।
এদিকে, বিএনপির দাবি গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে এবং পরবর্তীতে নয় দিনে ১৩২টি মামলায় তাদের পাঁচ হাজার ৫৫৯ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সরকার ভেবেছিল ভয়ভীতি-সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধী দলকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু চলমান কর্মসূচিতে দেশের মানুষ থেমে নেই। উসকানির মাধ্যমে একটি অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির দায় বিএনপির ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আজ দেশের মানুষ ইচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে।
তবে গ্রেপ্তার নিয়ে কর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজও পড়েছে। এ অবস্থায় দলটির উচ্চপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সিনিয়র নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের উদ্দেশ্য আছে। হতে পারে চলমান আন্দোলন থামানো এবং সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে রাজি করানো। এর মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নানা গুজব ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির একটি অংশ দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে নির্বাচন করবে। এজন্য দলের একজন নেতা কাজও করছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, ওয়ান-ইলেভেনসহ ১৭ বছর ধরে নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার নেতাকর্মীরা। হাইকমান্ডের নির্দেশের বাইরে তাদের নেতাকর্মীরা কেউ কোথাও যাবেন না। যতই চাপ বা প্রলোভন দেখানো হোক না কেন, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে কোনো নেতা যুক্ত হবেন না বলে তাদের বিশ্বাস।
এদিকে, সরকারের কঠোর মনোভাব এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন নীতিনির্ধারকরা। নেতারা মনে করেন, চলমান আন্দোলন দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। হরতাল ও অবরোধ উভয় কর্মসূচিতে জনগণের সমর্থন আছে। সরকারের দমন-পীড়নের বিষয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। সরকার দেশে ও দেশের বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচি নিয়েই রাজপথে থাকতে হবে।
একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, তাদের সামনে লাগাতার আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক, কোনো লাভ নেই। তফসিল ঘিরেই সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে আন্দোলনে নতুন মাত্রা পাবে। এছাড়াও তাদের বিশ্বাস, খুব শিগগিরই সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে আরও কঠিন চাপ আসবে। সেটা হলে নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হবে।
এদিকে, মহাসমাবেশের দিন ২৮ অক্টোবর থেকে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের বিভিন্ন সড়কে বাস, ট্রাক, অটোরিকশায় অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর করার খবর এসেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফায় রবিবার ও সোমবার সর্বাত্মক অবরোধ চলার সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ২১টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি বাস, দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার, একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি লেগুনা পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১১০টি অগ্নিসংযোগের সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর ২৯টি, ২৯ অক্টোবর ১৯টি, ৩০ অক্টোবর একটি, ৩১ অক্টোবর ১১টি, ১ নভেম্বর ১৪টি, ২ নভেম্বর সাতটি, ৪ নভেম্বর ছয়টি, ৫ নভেম্বর ১৩টি এবং ৬ নভেম্বর ১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
র্যাব জানিয়েছে, অবরোধের নামে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের জড়িতদের ধরতে বাহিনীটি কঠোর নজরদারি করবে। তাদের গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হবে।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :