ঢাকা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শর্তহীন সংলাপ চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ আহ্বান জানিয়ে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এতে সব পক্ষকেই পূর্বশর্ত ছাড়া সংলাপে বসার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সোমবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
এর মধ্যে গতকাল বিকেলে ডোনাল্ড লুর চিঠি নিয়ে পিটার হাস প্রথমেই যান রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে। সেখানে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। বৈঠকের পর দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।
এদিকে তফসিলের ঠিক আগমুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের আহ্বান নিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে নতুন মেরূকরণ দেখছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, এ বার্তার মূল বিষয় হতে পারে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা চায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বাংলাদেশে। এখানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে সব দল বিশেষ করে সংসদের বাইরে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় ওয়াশিংটন। এর আগে দেশটির শীর্ষ পর্যায় থেকে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতার তাগিদ দিলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থানে এ পর্যন্ত সংলাপের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ার ফলে বিএনপি যেমন তাদের ‘এক দফা’ সরকার পতনের দাবি আদায়ে অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনের জোর প্রস্তুতিতে মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণারও আর বেশি সময় বাকি নেই। আবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতও যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে।
ভারত বলেছে, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা মনে করে বাংলাদেশের নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে তাদের ‘হস্তক্ষেপ’ করার সুযোগ নেই। আবার এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার সমালোচনা করেছে।
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা ‘নাক গলাবে’ না। বাংলাদেশ তার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত ও চীনের অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে দুই বড় আঞ্চলিক শক্তির সমর্থন পেয়েছে সরকারপক্ষ। ফলে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে ভারতের ভিন্নমতের কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন কূটনৈতিক মেরূকরণ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিতেই সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে।
কূটনৈতিক একাধিক সূত্রের দাবি, ডোনাল্ড লুর এ চিঠির মূল বিষয় হলো বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। তারা এবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে। সরকার এবং সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকেও বারবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন না যাওয়ার সিদ্ধান্তে এখনো অনড়।
ফলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, বিএনপির মতো বড় একটি দল এবং তাদের মিত্র দলগুলো না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগে সরকারপক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি অংশ নিতে পারে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালি উর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তাদের যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে তারা তাদের প্রভাব বলয়ও তৈরি করতে চায়। ভারত আমাদের নির্বাচন নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এখন ওয়াশিংটন দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরবে। এখানে তারা বারবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে।
সরকার বারবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্র তা কানে তুলছে না। তারা এ সরকারকে পছন্দ করে না। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়েও তাদের আপত্তি আছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বয়স ৫৩ বছর। এর একটা শক্তি আছে। আর আওয়ামী লীগও চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক। রাজনৈতিক দলগুলো যদি শর্তহীনভাবে বসে, সেটা ভালোও হতে পারে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ তৎপরতার ফলে নির্বাচনের তফসিল এক সপ্তাহ পেছাতে পারে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি আমরা সবসময় বলি যে, অপছন্দ করলেও কিছু জিনিস আমাদের করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ। দেশের জনগণ যে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করেছেন, তারা সবাই মিলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সংবিধান তৈরি করেছেন। সেই সংবিধানটি বিভিন্ন সামরিক সরকারের সময়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আমরা এটিকে মোটামুটি আবার আগের জায়গায় আনার চেষ্টা করেছি। সেই সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধানের আলোকে যে আইন প্রণয়ন হয়েছে, সেটি অনুযায়ী নির্বাচন হবে।’
জাপার সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠক : গতকাল বিকেল ৩টায় জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে যান পিটার হাস। পরে বৈঠকের বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, তাদের কাছে চিঠিটি (ডোনাল্ড লুর) দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। রাষ্ট্রদূত তাকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছেও চিঠিটি দেওয়া হবে।
জাপা মহাসচিব আরও বলেন, চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে শর্তহীন সংলাপের আহ্বানও জানানো হয়েছে। চিঠির বাইরেও সমসাময়িক রাজনীতি এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে এবং সেগুলো ‘আনঅফিশিয়াল’ কথা বলে জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রকে জাতীয় পার্টি কী জানিয়েছে এ প্রশ্নে চুন্নু বলেন, ‘এটা তো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের কেন জানাব? আমাদের জনগণের দাবি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’
জাপা নির্বাচনের অংশ নেবে কি না এ প্রশ্নে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘এখনো এ বিষয়ে কিছু বলিনি। কারণ আমরা এখনো অপেক্ষা করছি সরকার একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। আমরা আশা করি, মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। তাহলে আমরা নির্বাচনের বিষয়ে চিন্তা করব। আগামীকাল মঙ্গলবার (আজ) দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা দিয়েছি। প্রয়োজনে পরদিন দলের প্রেসিডিয়ামের মিটিং ডাকব, সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একটা সিদ্ধান্তে আসব।’
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বিবৃতি ও ডোনাল্ড লুর চিঠি : গতকাল ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের জানান, তিনটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দেখা করার সময় চেয়ে তিনি অনুরোধ করেছেন। বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরা হয়। লুর চিঠিতেও তা রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়
১. যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। একই সঙ্গে সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।
২. যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না।
৩. যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানায়।
৪. যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণœ করে, তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ‘থ্রি সি’ ভিসানীতি কার্যকর করতে থাকবে।
এমটিআই