ঢাকা : বিএনপি নির্বাচনে এলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) তফসিল পরিবর্তনের ইঙ্গিত এবং তাতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই বলে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য- এ থেকে অনেকেই ভাবছেন, পর্দার আড়ালে দলটির সঙ্গে কোনো কথাবার্তা চলছে কি না। শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর)।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা গত মঙ্গলবার রাজশাহী বিভাগের নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাদের (বিএনপি) নির্বাচনে আসার এখনো সুযোগ আছে। তবে সেটা শিডিউল টাইমের (২৮ জানুয়ারি) মধ্যে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন হবে কি না, তা কমিশনাররা বসে বিদ্যমান আইন দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বস্তুত বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিংবা তাদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।
দেশের ভেতরে বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত, তাদের তিনজন দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এখন কারাগারে।
এছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতাসহ মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা অনেকটাই আত্মগোপনে। দলটির ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি যখন চলছে, তখন সম্প্রতি যোগ হয়েছে তাদের বিভিন্ন নেতার বাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল হামলা।
গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে বলেছেন, গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৯৫ জনের অধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। আর ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তার চার-পাঁচ দিন আগ থেকে অদ্যাবধি ১৭ হাজারের অধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।
এছাড়া দুবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় কারাবরণ করেছেন। সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পেলেও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন তিনি। তার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে নির্বাসনে আছেন। একাধিক মামলায় তিনি ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের সাজা হয়েছে।
এ অবস্থায় কীভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে- সেই প্রশ্ন তুলেছেন দলটির নেতারা। তাদের ধারণা, একটা ‘বিভ্রান্তি তৈরি’ করার জন্যই এসব কথা বলা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘এ অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রশাসন থেকে শুরু করে সবই তাদের (সরকার) কন্ট্রোলে। কেয়ারটেকার সরকার আসুক। আমরা নির্বাচনে যাব। তা ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মূল কথা হচ্ছে সরকারের কথায় মানুষের আস্থা নেই। তারা আজ এক কথা বলছে, কাল আরেক কথা।
আজ বিএনপিকে খুশি করার জন্য নির্বাচনী শিডিউল দুই-দিন-পাঁচ দিন পিছিয়ে দেবে আর বিএনপি তাদের উল্টোপাল্টা কথা আস্থায় নিয়ে লাফিয়ে নির্বাচনে যাবে- এটা মনে হয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’
ভারতে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ ‘এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই’ বলে জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু চিঠি দেওয়ার পর বিএনপি তার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসে। লুকে ফিরতি চিঠিতে এ কথা উল্লেখও করে দলটি। তবে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, একের পর এক ‘মিথ্যা মামলায়’ ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারে এমন সম্ভাব্য প্রার্থীকে সাজা দেওয়ায় সংলাপের পরিবেশ আর নেই বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, তারা নির্বাচনের চেয়ে মামলা মোকাবিলা কিংবা গ্রেপ্তার এড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। তবে ড. মঈন খান বলেছেন, ‘চূড়ান্ত কথা বলে রাজনীতিতে কিছু নেই। রাজনীতি হচ্ছে একটা ফ্লেক্সিবল জিনিস। গিভ অ্যান্ড টেকের ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালিত হয়। কাজেই এখানে আমি আমার গোঁ ধরে বসে থাকব, সরকার তার গোঁ ধরে বসে থাকবে- এটা তো হতে পারে না।’ তিনি মনে করেন, ‘সরকারকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।’
এ ‘পদক্ষেপ’ সম্পর্কে তিনি এর আগে বলেছিলেন, ‘২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের ওপর ক্র্যাকডাউনের পর থেকে সরকার যে মিথ্যা মামলা-হামলা ও অন্যায় গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করে আমাদের সকল নেতাকর্মীকে মুক্তি দিয়ে সবার আগে সরকার একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করুক। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।’
এ রকম কথাই গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংলাপ অনুষ্ঠানে উত্থাপন করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
তিনি সংলাপের আশা পোষণ করে বলেছেন, ‘আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে ২৯ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধানে কোনো বাধা নেই।’
তিনি বলেন, ‘তবে সরকারের উচিত ছিল অনেক আগেই আলোচনা করা, সংলাপে অবতীর্ণ হওয়া এবং জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সময় নেই এ কথা সত্য নয়।’
তার কথা হচ্ছে, সরকার বর্তমানে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণের আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে। কিন্তু সংসদ ভেঙে দিলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান সংবিধানই রয়েছে। এ বিধান অনুসরণ করলে সময় নেই এ কথা আর বলা যাবে না। এজন্য তিনি সরকারকে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলছেন।
এমটিআই