ঢাকা : আসনে আসনে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আওয়ামী লীগেরই অন্য নেতা, কিন্তু তাতে নেই ‘বিদ্রোহের’ আভাস। বিএনপি ও তার সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে দেশজুড়ে নির্বাচনি হাওয়া যতটুকু বইছে, তা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণেই।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম মাঠে থাকলেও তারা ভোটে লড়াই করার সক্ষমতা কতটা রাখেন, তা নিয়ে আছে সংশয়।
আগামী ৭ জানুয়ারির এই নির্বাচন সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমার দিনই একটি রেকর্ড হয়ে গেছে। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে প্রায় সাড়ে সাতশ। এর আগে যে ১১টি নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটিতে এত বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যায়নি।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে থাকা রফিকুল ইসলাম মনে করেন, ২০১৪ সালের মতই ভোট বর্জনের পুনরাবৃত্তি হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বেড়েছে।
এর আগের জাতীয় নির্বাচনগুলোর প্রবণতা তুলে ধরে তিনি বলন, যখনই দেশে এভাবে বড় দলগুলোর কেউ ভোটে আসেনি, সেগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেড়েছে।
তিনি বলেন, এখন মাঠ মোটামুটি ফাঁকা। এ ফাঁকা মাঠে আমিও গোল দিয়ে দিতে পারি, এমন আশায় নেমেছে অনেকে। সেই সঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহব্যঞ্জক আশ্বাসে স্বতন্ত্রের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে নিজ দলের মনোনয়ন না পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলে যোগদানের ঘটনা যেমন অতীতেও দেখা গেছে, তেমনি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোট করার প্রবণতাও ছিল। আবার কিছু এলাকায় নানা সময় নানা কারণে দল নিরপেক্ষরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ভোটে জিতেও এসেছেন।
তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অনুপস্থিতিতে আসনে আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য লড়াই নিজ দলের ‘শক্তিমান’ অন্য নেতার সঙ্গে হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিএনপির শূন্যতা পূরণে ‘ডামি বা স্বতন্ত্র’ : নির্বাচনি ডামাডোলের যখন অপেক্ষা, সে সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বার্তা ছিল, যাকেই তিনি মার্কা দেবেন, ভোট দিতে হবে তাকেই।
কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত ভোটে আসছে না, এ বিষয়টি যখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, তখন তিনিই নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি আসনে আসনে অন্য প্রার্থী প্রস্তুত রাখতে বলেন।
দলের ভাষ্য ছিল, ‘ডামি প্রার্থী’ দেখতে চেয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান; তবে তৃণমূলে গেছে অন্য বার্তা। বিপুল উৎসাহে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অন্য দলে গিয়ে নয়, তারা সবাই দলনিরপেক্ষ হিসেবে প্রার্থিতা জমা দিয়েছে।
আসনে আসনে নৌকার সঙ্গে দলের নেতাদের লড়াইয়ে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে কি না, ভবিষ্যতে ঐক্য নষ্ট হয় কি না, এসব আলোচনাও আছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ দৃশ্যত ‘ডামি বা স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের রাশ টানতে চাইছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঢালাওভাবে সবাই স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে বিষয়টা এমন নয়। ১৬ তারিখ পর্যন্ত দলীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
আওয়ামী লীগকে অন্য দলগুলো চ্যালেঞ্জের ক্ষমতা রাখে কতটা?
আওয়ামী লীগ প্রাথমিকভাবে ২৯৮টি আসনে দলের মনোনয়ন জমা দেয়। পরে ৫টি আসনে দুটি করে মনোনয়ন জমা পড়ে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মনোনয়ন জমা দেয় ২৮৬ টি আসনে। পরে ১৮টি আসনে দুটি করে দলীয় মনোনয়ন জমা দেয়।
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টি ১৯৯০ সালে তার পতনের পর থেকে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে।
তার ওপর এবার চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে দল আরও দুর্বল হয়েছে। রওশন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ভোটে যাচ্ছেন না।
কয়েক মাস দোদুল্যমান থাকার পর জাতীয় পার্টি ভোটে আসার ঘোষণা দিলেও দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব দলটিকে নির্বাচনে ভোগাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে লড়াই করে ৩৫টি আসন পায়। তবে তাদের ভোট ছিল প্রধানত বৃহত্তর রংপুর এবং সিলেট বিভাগের আসনে।
সে সময় বৃহত্তর রংপুরের ২২টির মধ্যে ১৮টি, সিলেট বিভাগে ১৯টি আসনের মধ্যে আটটি পায় জাতীয় পার্টি। এর বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় দুটি করে, রাজশাহীর, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালীতে একটি করে আসন পায় তারা।
দেশের বাকি অঞ্চলগুলোতে খুলনার কিছু এলাকা এবং ময়মনসিংহের অল্প বিস্তর আসনে ভোট পায় দলটি।
১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট বেড়ে হয় প্রায় ১৭ শতাংশ, তবে আসন কমে হয় ৩২টি। নতুন কোনো এলাকায় ভোট টানতে তারা ব্যর্থ হয়।
এরপর এরশাদের দলে নানা ভাঙন ধরে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে যান। পরে এরশাদ ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে গঠন করেন চারদলীয় জোট।
তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে আগে সেই জোট থেকে তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় ভাঙনের শিকার হয় দলটি। নাজিউর রহমান মঞ্জু ও এম এ মতিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি নামে দলের আরেকটি অংশ থেকে যায় এই জোটে।
এই ভাঙনের জাতীয় পার্টির ভোটে অর্ধেক হয়ে যায়। ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৭ শতাংশের কিছু বেশি পায় দলটি। আসন কমে হয়ে যায় ১৭টি। রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান হারিয়ে ফেলে তারা, এমনকি প্রভাব কমতে থাকে রংপুরেও।
পরের তিনটি নির্বাচন জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। দেখা গেছে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিয়েছে, কেবল সেখানেই জিতে আসতে পারছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। যেখানে উন্মুক্ত লড়াই হয়েছে, তার সব জায়গায় বড় ব্যবধানে হেরেছেন তারা। এমনকি বৃহত্তর রংপুরেও প্রভাব হারিয়ে ভোটে তলানিতে থাকছে তারা।
নতুন নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমে বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য থাকলেও তারা এর আগে জিতেছিলেন বিএনপির হয়ে। নতুন এই দুই দল ভোটে কতটা সুবিধা করতে পারে, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন।
বিএনপি থেকে ভাগিয়ে এনে এই দুটি দল যাদেরকে প্রার্থী করেছে, তাদের মধ্যে যারা বিএনপির পদে ছিল, তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে, বাকিরাও নানা সময় দলে অপাংক্তেয় হয়ে গেছেন, কেউ কেউ রাজনীতি থেকে ছিলেন দূরেও।
ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরের মত কয়েকজনেরই এলাকায় প্রভাব আছে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরসা কি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্ররাই?
ফরিদপুর-৪ আসনে পরপর দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী জাফর উল্লাহকে হারিয়ে তুমুল আলোচিত যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) এবারও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন স্বতন্ত্র পরিচয়েই। এবারও তাকে নৌকা না দিয়ে জাফর উল্লাহকেই প্রার্থী করেছে ক্ষমতাসীন দল।
ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ শামীম হককে প্রার্থী করার পর আসনটিতে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ী এ কে আজাদের প্রার্থিতা জমা দেওয়ার পর।
বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে রাজধানীর আসনগুলোতে ঢাকা-৭ আসনেই যা কিছু লড়াই জমেছিল।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রতীক দিয়েছিল আগেরবারের সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে। ১৯৯৬ সালে এই আসনে জয় পাওয়া হাজী মোহাম্মদ সেলিম প্রতীক না পেয়ে দাঁড়ান স্বতন্ত্র পরিচয়ে। জয় পান তিনিই।
সেই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান প্রার্থীরা। বাকি যেসব আসনে ভোট হয়, সেগুলোর মধ্যে বলার মতো লড়াই হয় কিন্তু ঢাকা-৭ এর মতো আরও ১৫টি আসনে। এর প্রায় সবগুলোতেই নৌকার সঙ্গে লড়াই হয়েছিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে।
সেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকের বেশি আসনে জয় নিয়ে এখনও কথা শুনতে হয় আওয়ামী লীগকে। মূলত এ কারণেই দলের পক্ষ থেকে এবার কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কোথাও আসন ফাঁকা রাখা যাবে না।
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই এলাকায় জনপ্রিয়তার প্রমাণ রেখেছেন অতীতে।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরের মুশফিকুর রহমান খান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে প্রার্থী হয়েছেন মানিকগঞ্জ-২ আসনে। তিনি সিঙ্গাইরের উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন এই ভোটে অংশ নিতে।
নরসিংদীর মনোহরদীতে মো. সাইফুল ইসলাম খান বীরু উপজেলা নির্বাচনে টানা জয় পেয়ে আসছেন। তিনিও পদে ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন নরসিংদী-৪ আসনে।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান সুমনও পদ ছেড়েছেন। তিনি নির্বাচন করবেন ময়মনসিংহ-৮ আসনে। একটি উপজেলা নিয়েই সেখানে আসন। গত দুটি নির্বাচনে সেখানে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এবার অবশ্য নৌকা মার্কার প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুমন শেষ পর্যন্ত লড়াই করলে জাতীয় পার্টির জন্য তা সুখকর নাও হতে পারে।
হবিগঞ্জে-৪ আসনে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর মধ্যে লড়াই হতে পারে বলে এরই মধ্যে আভাস মিলেছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর হাতিয়ার হতে যাচ্ছে। তবে এই কৌশলে সহিংসতা হলে তা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলেও মনে করেন তিনি।
২০১৪ সাল থেকে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতে বহু মানুষের প্রাণ গেছে।
রফিকুল ইসলাম মনে করেন, বেশি বেশি ‘দলীয় স্বতন্ত্র’ প্রার্থী ভোটে বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে প্রার্থী বাড়লেও গোলযোগ-সংঘাত হলে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসাটাই চ্যালেঞ্জ হবে। সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখলেও ভোটের মাঠে কেমন পরিস্থিতি হয় তা ভবিষ্যতে বলবে।
তিনি বলেন, এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (বিচারিক, নির্বাহী হাকিম, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ, প্রশাসন) নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ এবং ভোটারদের কেন্দ্রে আনার পরিবেশ নিশ্চিত বিধান করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলের মধ্যে বিরোধ বাড়বে, অসহিষ্ণুতা দেখা যাবে, দলীয় কোন্দল হবে যা দলের জন্য ভীষণ ক্ষতি হবে।
এবার কত স্বতন্ত্র : নির্বাচন কমিশনের হিসাব বলছে, ৩০ নভেম্বর যে পৌনে তিন হাজার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে তার মধ্যে দলীয় প্রার্থী ১৯৬৬ জন। দল নিরপেক্ষ প্রার্থীর সংখ্যা ৭৪৭।
অবশ্য এদের সবাই যে শেষমেশ প্রার্থী হবেন, তা নিশ্চিত নয়। কারণ বাছাইয়ে বাদ পড়ে যেতে পারেন অনেকে। ১৭ ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। তখনই বলা যাবে এবারের চূড়ান্ত প্রার্থী কয়জন।
এর আগে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৮৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াটা ছিল রেকর্ড। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের রেকর্ড গড়েন বড় দলের বর্জনের দুটি ভোটে।
দলনিরপেক্ষ প্রার্থীরা শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি ভোট পান ২০১৪ সালে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান ১৯৮৮ সালে।
তবে সে সময় যে কেউ চাইলেই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যেতে পারতেন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন থেকে স্বতন্ত্র দাঁড়াতে হলে নির্বাচনি আসনের কমপক্ষে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ দিতে হয়, যে কারণে এরপর প্রকৃতপক্ষে দলনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা কমেছে। এরপর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই দলীয় পরিচয় থাকছে। তারা দলের মনোনয়ন না পেয়ে একটি অংশের সমর্থনে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন।
অতীতের খতিয়ান
# ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৯ প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ১২০ জন। তারা ভোট পেয়েছিলেন ৫.২ শতাংশ।
# ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ২ হাজার ১২৩ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ৪২২ জন। তারা পেয়েছিলেন মোট ভোটের ১০.১০ শতাংশ।
# ১৯৮৬ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ১২৪ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ৪৫৩ জন। তবে সেই নির্বাচনে তারা খুব একটা ভোট টানতে পারেননি, প্রদত্ত ভোটের ১.৭৩ শতাংশ পায় তারা।
# ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বর্জনের মধ্যে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভোট পান। সেই নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ৯১৯ জন, যার মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ২১২ জন। তারা পান প্রদত্ত ভোটের ১৩.৫০ শতাংশ।
# ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ২ হাজার ৭৮৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ৪২৪ জন, তারা ভোট পান ৪.৩৯ শতাংশ।
# ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের বর্জনের মধ্যে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৪৫০ জন। সেই নির্বাচনের অনেক তথ্যই পাওয় যায় না। তবে স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রার্থীদের ১০টি আসনে জয়ে তথ্য আছে।
# ১৯৯৬ সালের জুনের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে ২ হাজার ৫৭৪ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ২৮৪ জন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পড়ে ১.০৬ শতাংশ।
# ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ভোট, দুটোই আবার বাড়ে। সেই বছর ১ হাজার ৯৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিল ৪৮৬ জন, তারা পান প্রদত্ত ভোটের ৪.০৬ শতাংশ।
# ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় কড়াকড়ি করে তৎকালীন ইসি। এসময় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ভোটারদের আগাম সমর্থনের প্রমাণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ হয়। এতে কমে আসে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা। এ নির্বাচনে ১ হাজার ৫৬৭ প্রার্থীর মধ্যে ১৫১ জন ছিলেন স্বতন্ত্র, যারা পান প্রদত্ত ভোটের ২.৯৮ শতাংশ, আসন পায় ৪টি।
# আনুপাতিক হারে স্বতন্ত্র সবচেয়ে বেশি ছিল বিএনপি-জাময়াত জোটের বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে।
# সেই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে একজন প্রার্থী ছিল বলে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭ আসনে প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন, এর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ১০৪ জন।
# সেই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ১৫.০৬ শতাংশই পান এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা আসন জেতেন ১৬টি। এদের সবাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ভোটে দাঁড়ান সে সময়।
# ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ১২৮ জন। মোট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ১ হাজার ৮৬১ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ৩ আসনে। তবে তাদেরও দলীয় পরিচয় ছিল।
এমটিআই