ঢাকা : দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৪ দলের আসন ভাগাভাগি নিয়ে জোটের নেতারা বসলেও হয়নি সমাধান। এ নিয়ে দেনদরবার চলবে আরও দু-একদিন।
কৌশলে এ বিষয়টি অন্য নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন জোটনেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ নিয়ে প্রকাশ্যে জোটনেতারা সন্তোষ প্রকাশ করলেও ভেতরে পুষছেন ক্ষোভ। শেষ পর্যন্ত কী করে আওয়ামী লীগ, এটি দেখার অপেক্ষায় অনেকে।
সোমবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যার পর গণভবনে জোটনেতাদের নিয়ে বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্ধারিত বৈঠকে যোগ দিতে মাগরিবের পর থেকে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নজিবুল বশরসহ শরিক দলের শীর্ষ নেতারা গণভবনে প্রবেশ করেন।
জোটনেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সন্ধ্যা ছয়টার পর বৈঠক শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষ করে জোটনেতারা গণভবন থেকে বের হন পৌনে ১০টার দিকে।
বৈঠকের পর গণভবন থেকে বের হলে জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা হয়।
তারা জানিয়েছেন, সোমবারের বৈঠকে আসন ভাগাভাগি হয়নি বা এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আওয়ামী লীগের চার নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তারা জোট শরিকদের সঙ্গে বসে ঠিক করবেন।
পৌনে চার ঘণ্টার এই বৈঠকে আসন ভাগাভাগি না হলে কী হয়েছে?- এমন প্রশ্নের জবাবে ১৪ দল নেতারা জানান, এটি ছিল মূলত সৌজন্য সাক্ষাৎ। সুখ-দুঃখের গল্প হয়েছে। ডিনারের আয়োজন ছিল। সৌহার্দ্যপূর্ণ মিলন ও ভোজসভা হয়েছে এটি।
তবে প্রকাশ্যে না বললেও জোটনেতারা জানিয়েছেন, তারা তাদের চাহিদা বা প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তালিকা দিয়েছেন। এরই মধ্যে জোটের শরিকদল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন- এই চার দলের প্রধানের (৪টি) আসন বণ্টনের বিষয় মোটামুটি চূড়ান্ত হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এটি মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দেবেন। তবে, এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আরও দেনদরবার হবে।
শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে তাদের দলের অন্য নেতাদের ফোনালাপ ও কথোপকথনে জোটের ভেতরে ক্ষোভ অনুমিত হয়েছে। তবে, নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশে বেশ সতর্ক জোটনেতারা। এখনই সেই সময় আসেনি বলে মনে করেন তারা। এজন্য আপাতত চুপ থাকছেন। তারা দেখতে চান- জোটের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কী করে।
এ নিয়ে জোট শরীক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা আসন ভাগাভাগি বা বণ্টনের কথা বলেছি। বলেছি যে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, অতিদ্রুত আসন ভাগাভাগি করেন। তা না হলে যারা মাঠে আছে, তাদের সঙ্গে সুসমন্বয় হবে না। তাদের তো বসিয়ে দিতে হবে।
এছাড়াও অনেক কথার পরে আসন ভাগাভাগি নিয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) যেটা বললেন, ‘১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আপনাদের (শরিক দল) সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত করবেন’।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘বৈঠকে দেশের সামগ্রিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলো। ১৪ দলের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জোটগতভাবে নির্বাচনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হলো। আসন সমঝোতা নিয়ে কিছুটা আলোচনা হয়েছে, বিস্তারিত হয়নি। এটার মূল দায়িত্ব ১৪ দলের সমন্বয়কের ওপর দেওয়া হয়েছে।’
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যার সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। তিনি আজ খুব হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। একসঙ্গে খাবার খেয়েছি আমরা। অনেক কথার মধ্যে তিনি আমাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য সব দলের প্রার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন। বলেছেন, জোট আছে, থাকেবে। জোটগতভাবেই নির্বাচন করবো।’
আসন বণ্টন নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হচ্ছে, নৌকা নিয়ে আমরা নির্বাচন করবো। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আসন চেয়ে তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছেন সিনিয়ররা। আমাদের প্রত্যাশা তো অনেক। তবে, বড় প্রত্যাশা দেশকে বাঁচানো। আমরা যারা দলের প্রধান আছি বা যারা সংসদে আছি দলের প্রধান, এই চারজনেরটা মোটামুটি নিশ্চিত। আরও কিছু বাড়তেও পারে। যেহেতু ওবায়দুল কাদের বলবেন, আমি বলতে চাইছি না।’
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী আরও জানান, জোটের আসন বণ্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করে চূড়ান্ত করবেন।
১৪ দলের আরেক শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমরা ১৪ দল সুখে-দুঃখে রাজনৈতিক বিভিন্ন চক্রান্তের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করেছি। আজ (সোমবার) মূলত ১৪ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনা জোট নেতাদের সঙ্গে রাতের ভোজসভার আয়োজন করেছেন। এটি আমাদের ১৪ দলের সৌহার্দ্যপূর্ণ একটা মিলনসভা ছিল। এতে আমরা সুখ-দুঃখের গল্প করেছি। পরিস্থিতির ওপর সাধারণ গল্প হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জোটনেত্রী বলেছেন- জোট আছে, আমি জোটে বিশ্বাস করি। জোটগতভাবেই নির্বাচন হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সবাই। জোট সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে জোটের আসন ভাগাভাগি করেন দ্রুততার সঙ্গে।’
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, ‘আজ মূলত শুভেচ্ছা বৈঠক ছিল। অনেকদিন পর নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক, খাওয়া-দাওয়া হলো ভালো, ভূরিভোজ হলো। আর আসনের ব্যাপারে উনি (শেখ হাসিনা) আমু ভাইকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। তিনি দলগুলোর সঙ্গে বসবেন।’
বৈঠকে অংশ নেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক, গণআজাদী লীগের সভাপতি এস কে শিকদার, সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ খান, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি সভাপতি জাকির হোসেন, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি মোজাফফর আহমেদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান প্রমুখ।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে বলা হয়, এ বিষয়ে মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ব্রিফ করবেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
গত ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শরিকদের মাত্র দুটি আসন ছেড়ে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
এমটিআই