• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঢালাও বদলির সিদ্ধান্তে প্রশাসনে অস্বস্তি


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৮, ২০২৩, ০৪:৪৪ পিএম
ঢালাও বদলির সিদ্ধান্তে প্রশাসনে অস্বস্তি

ঢাকা : নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে কাজ করা সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে বদলি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। 

রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। 

অন্যদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার তাগিদ রয়েছে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে। 

মূলত এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে ‘কর্মকর্তা বদলি’র এ কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে। তবে ঢালাও বদলির সিদ্ধান্তে অসন্তোষ বিরাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা এ ঢালাও বদলিকে ‘গুরুত্বহীন’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ কাজ বলে মনে করছেন। 

সকল ইউএনও-ওসিকে বদলির সিদ্ধান্ত : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বদলি করতে গত ৩০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথম পর্যায়ে যেসব থানার ওসিরা বর্তমান কর্মস্থলে ৬ মাসের বেশি সময় আছেন, তাদের অন্য জেলায় বা অন্য থানায় বদলির নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে ইসি আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সারা দেশের ওসিদের বদলি করতে আরও সময় চায় জননিরাপত্তা বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিন সময় বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন ওসিদের পর্যায়ক্রমে বদলির প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে ৫ ডিসেম্বরের পরিবর্তে আগামী ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠাতে হবে।

দেশের ৬৪ জেলায় ৬০০টির বেশি থানা আছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে এসব থানার ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। 

এরপর নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) পর্যায়ক্রমে বদলি করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। একই দিন সাংবিধানিক এই সংস্থা ইউএনওদের বদলির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর পাঠানো ইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সব ইউএনওকে পর্যায়ক্রমে বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যেসব ইউএনওর বর্তমান কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ এক বছরের বেশি হয়ে গেছে, তাদের অন্য জেলায় বদলির প্রস্তাব ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসিতে পাঠানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। 

এরপর কোন ইউএনও কত দিন ধরে একই উপজেলায় রয়েছেন সেই তথ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিভাগীয় কমিশনাররা। ৪ ডিসেম্বর সেই তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হয়। 

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা যে শর্ত দিয়েছিলাম ওসিদের জন্য ৬ মাস, সেই অনুযায়ী যতটুকু জেনেছি ৩২০ জনের মতো ওসি আর ইউএনওদের ক্ষেত্রে ১ বছর, সেই অনুযায়ী ২৫০ জনের মতো ইউএনও বদলি হতে পারে। 

ওই দিন কমিশন ৪৭ জন ইউএনওকে বদলির সুপারিশ এলে তা অনুমোদন করে। বদলি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সারা দেশে মোট ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ এ বদলির বিষয়ে বলেছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে নির্বাচন কমিশনাররা যে তথ্য পেয়েছেন তার ভিত্তিতেই ইউএনও ও ওসিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এর ফলে নতুন এলাকায় গিয়ে কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন বলে আশা করছে কমিশন।

দুই ডিসিকে সরানো হলো, আরও পরিবর্তন আসতে পারে : নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তফসিলের পর ইতোমধ্যে দুই জেলার প্রশাসক (ডিসি) পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের ডিসিকে গত ২ ডিসেম্বর বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

ময়মনসিংহের ডিসি মো. মোস্তাফিজার রহমানকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের ডিসি দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীকে ময়মনসিংহের ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। 

অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে সংযুক্ত উপসচিব মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীকে সুনামগঞ্জের নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ডিসি পদে আরও পরিবর্তন আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ইসি। নির্বাচন কমিশন আপত্তি জানালে যে কাউকে যে কোনো সময় বদলি করা হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। নির্বাচনকে বিন্দুমাত্র প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন কোনো কাজ করতে চাইছে না সরকার।

বদলির সিদ্ধান্তে অসন্তোষ : ঢালাও বদলির সিদ্ধান্ত আসার পর মাঠ প্রশাসনে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এ সিদ্ধান্তে তাদের ঝামেলা পোহাতে হবে। ইউএনও, ওসিদের বদলি প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অনেক এমপি ও মন্ত্রীও। আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের বদলিতে তারা বিপাকে পড়বেন বলে দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের জানিয়েও দিয়েছেন তারা। 

বদলির সিদ্ধান্তের বিষয়ে কয়েকজন ইউএনও এবং ওসি জানান, মাঠের এমন রদবদলে তারা বিপাকে পড়বেন। অনেক কর্মকর্তার সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। কেউ কেউ অনেক তদবির করে সরকারি চাকুরে স্ত্রীকে নিজ কর্মস্থলের কাছে বদলি করে এনেছেন। বদলি ঠেকাতে ইসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদবিরে নেমেছেন অনেকে। 

এ ছাড়া ওসিদের তালিকা চাওয়ার পর থেকে পুলিশের নানা মহলে তদবির শুরু হয়েছে। ভালো পদায়ন পাওয়ার জন্য কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করছেন।

এর আগে সরকারদলীয় যে এমপি ও মন্ত্রীরা পছন্দ করে ডিসি, পুলিশ সুপার, ইউএনও এবং ওসিদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় বদলি করে নিয়ে গেছেন, তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এরই মধ্যে সরকারদলীয় এমপি ও মন্ত্রীদের কেউ কেউ পছন্দের ইউএনও এবং ওসিদের রাখতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তদবির শুরু করেছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের অধীনে রয়েছেন। তারা যে নির্দেশনা দেবেন, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।

বিএনপিসহ অনেক দল নেই ভোটে : রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ছাড়াও বেশির ভাগ বামপন্থি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। জাতীয় পার্টিসহ ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর অংশগ্রহণে এ নির্বাচন মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারছে না।

তারপরও সরকার একটি ‘উৎসবমুখর’ নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে চায়। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসি। এ বদলি কৌশলও সেই পদক্ষেপের অংশ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। 

তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে এমন পরিবর্তন করা হতো না বলে মনে করছেন অনেক কর্মকর্তা। গত ৩ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ইউএনও ও ওসি বদলির সিদ্ধান্তটি আওয়ামীমনা রদবদল মাত্র। সমগ্র প্রক্রিয়াটি হাসি-তামাশার নজিরবিহীন নাটক।’

এ বদলির গুরুত্ব নেই : মাঠ প্রশাসনের এমন রদবদলে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। 

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এই নির্বাচন একতরফা হচ্ছে। একটি ভালো নির্বাচনের যে রকম পরিবেশ দরকার, তা নেই। মাঠ প্রশাসনে যে বদলির কথা বলা হচ্ছে, তাতে কোনো সুফল আনবে না। এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এখন যে বদলি হচ্ছে, তা নেহাত অপ্রয়োজনীয়। এটা করে কোনো ফল আসবে না; বরং সরকারের ব্যয়ের ব্যাপার আছে। বদলি-ভাতা বাবদ সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এই বদলির কারণে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোগান্তি বাড়বে। নির্বাচন কী রকম হতে যাচ্ছে, সেটা সবাই দেখছে।’

নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন কমিশন নিজের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য এমন আদেশ দিয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব বদলির খুব একটা গুরুত্ব নেই বলেই মনে করেন তারা।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ঢালাও বদলির এ সিদ্ধান্ত লোক দেখানো, এসব ডিসি, ইউএনও ও ওসিদের নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকার পোস্টিং ও পদায়ন করেছিল। এখন তাদের এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় দেওয়ার আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ তারা সরকারি দলের অনুগত হিসেবেই পোস্টিং ও পদায়ন পেয়েছেন। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!