ঢাকা : জানুয়ারিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদলগুলো সরকারের পদত্যাগ ও একটি অন্তর্বর্তী নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধীদের চাপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই প্রক্রিয়ায় দেশের রাজপথ রাজনৈতিক উত্তালের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আর বাংলাদেশের জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে সম্ভবত দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন মেরামতের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল থিংক ট্যাংক ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি) -এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সহিংসতা ও পরবর্তীতে বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ড. জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ডের লেখা প্রতিবেদনটিতে। ২২ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংগঠনটি।
ইউএসআইপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী সমর্থকরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ও বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করেছে। একটি পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে এবং সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছে।
২৮ অক্টোবর প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের একটি বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আসন্ন নির্বাচন নির্দলীয় প্রশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত করার "এক দফা দাবি" নিয়ে "মহা সমাবেশ" ডাকে। সমাবেশে জামায়াত-ই-ইসলামী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল যোগ দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সেসময় আওয়ামী লীগকে "শান্তি সমাবেশ"করতে দেখা গেছে। আর এটি ছিল দলটির অসহিংসমূলক জনপ্রিয়তা প্রদর্শনের একটি সুন্দর ব্যবস্থা।
বিএনপির অভিযোগ রাজপথে সকল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় একদিকে পুলিশ ও আ.লীগ সমর্থক এবং অন্যদিকে বিএনপি কর্মীদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয় বিক্ষোভের সময়। বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় উভয় পক্ষ এ সময় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। পুলিশকে নিরস্ত্র নাগরিকদের লাঞ্ছিত এবং ভিড়ের মধ্যে নির্বিচারে গুলি চালাতে দেখা গেছে। বিরোধী সমর্থকদের একদল জনতা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে পিটিয়েও হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করে। এছাড়াও একটি পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেয়া, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা এবং সাংবাদিক লাঞ্ছিতের ঘটনা ঘটেছে এই বিক্ষোভের সময়।
বিএনপির দাবি তাদের সমর্থকদের সহিংস করে তুলতে ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানি দেয়া হচ্ছিল যা সরকারী নাশকতার একটি অংশ ছিল বলে তারা অভিযোগ করেছে। কিন্তু সহিংসতা এবং সম্পত্তি বিনাশে দলটির দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। জবাবে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির মহাসচিবসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। আ.লীগের যুক্তি যে বিএনপির রাজনৈতিক সহিংসতা শাস্তিমুক্ত হতে পারে না।
আর এমন সমাবেশ বানচালের পর থেকে বিরোধীদল তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। জনবিক্ষোভ থেকে দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং অবরোধের ডাকে সারা দেশে পরিবহন ও বাণিজ্য ব্যবস্থা অচলের লক্ষ্যে তারা অবরোধের প্রথম দুই সপ্তাহে অন্তত ১০০টি গাড়িতে আগুন দেয়। বিএনপি আবার এমন সহিংসতায় সরকারের যোগসাজশের কথা যদিও বলছে কিন্তু দলটির সমর্থকরা অনেক ক্ষেত্রেই এ সহিংসতার সঙ্গে জড়িত। সরকারের দাবি অবরোধ এবং সহিংসতার ফলে অনেক ব্যস্তপূর্ণ জনসমাগম অঞ্চল শূন্যে পরিণতের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জট : বাংলাদেশের অস্থির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ছে উদ্বেগ। তারাও ক্রমশ এটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। গত দুই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা সরকারগুলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য চাপ দিয়ে আসছে। বিরোধীরা এই বাহ্যিক চাপকে গ্রহণ করে। বিএনপি ধারাবাহিকভাবে মার্কিন নীতি এবং গণতন্ত্রের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নানা বিবৃতির প্রশংসাও করে যাচ্ছে। দলটির এক নেতা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দলের ত্রাণকর্তা বলেও অভিহিত করেছেন। আর বিএনপির দাবি ইউরোপিয় ইউনিয়নের মতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় তারা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছে। ২৮ অক্টোবর সহিংস সংঘর্ষের পর বিএনপির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমা সরকারের কাছে জবাবদিহি করবে।
অন্যদিকে, ভারত ও চীন স্থিতাবস্থাকে জোরদার করছে। যদিও ভারত বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন নীতিতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি দেশটি বলছে আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের "অভ্যন্তরীণ বিষয়"। অন্যদিকে পশ্চিমাদের চাপের মুখে আওয়ামীলীগ দিল্লির এই কূটনৈতিক সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে চীন আগে বাংলাদেশে আমেরিকান "হস্তক্ষেপের" সমালোচনা করলেও সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির সংবিধান অনুসরণেই হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে। আর এটিকে বিএনপি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অবস্থানের প্রতিধ্বনি অভিহিত করে নিন্দা জানিয়েছে।
পশ্চিমা দূতাবাস, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এবং দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। আওয়ামীলীগ সংলাপের জন্য পথ খোলা রাখলেও ৭ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর দলটি বিকল্প এ পথটি বন্ধ করে দেয়। এদিকে, বিএনপি সংলাপের বিষয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। তাদের ভাষ্য-উভয় পক্ষ বসে আলোচনা করলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনগুলোর ত্রুটি উল্লেখ করেছে তারা। বিএনপি তার অবস্থানে অনড় অথচ যখন আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে জানিয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ২০১১ সালে আদালতের দেয়া রায়ের ফলে বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
ভবিষ্যত কোন দিকে যাচ্ছে?
নির্বাচন বর্জনের কৌশল এবং ক্ষমতাসীন দলের পদত্যাগের জন্য অবরোধ কর্মসূচীকে অহিংস হিসেবে দাবি করে প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যত বিএনপি ও বিরোধীদলগুলোর এই কর্মসূচী সহিংস হয়ে উঠেছে। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি নির্বাচন বাতিলের জন্য অবিরাম হরতাল ডাকলেও সরকারি দল আওয়ামীলীগের জন্য এটিকে চাপ হিসেবে নেয়ার মত কোনো ইঙ্গিত মিলেবি। কিন্তু সহিংসতা বন্ধ করে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি না হলে দেশটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে। সূত্র: ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস’র ওয়েবসাইট
এমটিআই