ঢাকা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়া কৌশলে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধীদের আন্দোলনকে আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। পুরোদমে নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত দলটি। নিজ নিজ আসনে ভোটারদের কাছে টানতে দিন-রাত কাজ করছেন নৌকার প্রার্থীরা। ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব তাদের। একই সঙ্গে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। এতদিন পালটা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ছিল ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু এখন হরতাল-অবরোধ প্রতিহতেও ঢিলেঢালা ভাব আওয়ামী লীগে। এমনকি বিএনপি ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচিতেও গুরুত্ব দিচ্ছে না তারা। দলটির দৃষ্টি এখন শুধু নির্বাচনে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে শুরু থেকেই নানা কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের এ ভোটে শেষ পর্যন্ত আমেজ ধরে রাখা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর এখন ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য। দলটির নেতারা বলছেন-বিএনপির এসব কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। ফলে অতীতের অন্যান্য কর্মসূচির মতো এ কর্মসূচিও ব্যর্থ হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি এখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু জনগণই তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগ শুরু করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে অসহযোগ শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ বাংলাদেশের হাট-বাজার, দোকানপাটে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক।
একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপির এই অসহযোগ আন্দোলন দেশের ১৬ কোটি মানুষের বিপক্ষে। মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। বিএনপির অপরাজনীতি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। তাদের আন্দোলনে মানুষ সাড়া দেয়নি। হরতাল হয়নি। তাদের অবরোধ মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে। এই কর্মসূচিতে দেশের মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ফলে তাদের (বিএনপি) এ কর্মসূচিও অতীতের অন্যান্য কর্মসূচির মতো ব্যর্থ হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, বিএনপি কখনই শান্তিপূর্ণ বা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেনি। তারা অতীতেও আন্দোলনের নামের মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এখনো আন্দোলনের নামে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অতীতেও কখনো তাদের (বিএনপির) আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল না। ফলে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এবারও তারা যে কর্মসূচি (অসহযোগ) ঘোষণা করেছে। এতেও জনগণের সমর্থন নেই। ফলে তাদের এ কর্মসূচিও ব্যর্থ হবে।
ক্ষমতাসীন দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, বিএনপি নিজেই অসহযোগিতার মধ্যে আছে। বিএনপি এই যে আন্দোলনের নামে যা কিছু করছে, এতে তো সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই। জনগণ কোনো ভাবেই তাদের এসব কার্যক্রম পছন্দ করছে না। ফলে তাদের কোনো কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাদের সব কর্মসূচিই ব্যর্থ হবে। মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। মানুষ তাদের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক যে অধিকার সেটা অক্ষুণ্ন রাখতে চায়।
গত ডিসেম্বরের পর থেকে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির দিনে পালটা কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কঠোর অবস্থান দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি মিছিল-সমাবেশে বাঁশের লাঠি, স্টাম্প, হকিস্টিক নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। প্রতিটি কর্মসূচিতে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হরতাল-অবরোধের প্রতিদিনই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ক্ষমতাসীনরাও।
নানা কর্মসূচি নিয়ে সরব ছিল জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। কিন্তু এখন আর এসব কর্মসূচি পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বিএনপির হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে আগের মতো মাঠের কর্মসূচিতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না দলটি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-বিএনপি শুরু থেকে চেয়েছে নির্বাচন বন্ধ করতে। ২৮ অক্টোবরের পর তারা টানা হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এসব কর্মসূচিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। আন্দোলনে ‘ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন ভোটারদের নির্বাচনবিমুখ করে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। মাঠের কর্মসূচিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না বলেই তারা এমনটি করছে। ফলে নিজেদের কর্মসূচিও সেভাবেই ঠিক করছে ক্ষমতাসীনরা।
একই সঙ্গে কর্মসূচির আড়ালে বিএনপি ও তাদের দেশি-বিদেশী মিত্রদের নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও রয়েছে আওয়ামী লীগের। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন, প্রার্থী যাচাই-বাছাই শেষে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর আওয়ামী লীগের পুরো মনোযোগ নির্বাচনের দিকে।
আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে। তারা মনে করছে এতে একদিকে যেমন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে অন্যদিকে দেশ-বিদেশে নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্নও তুলতে পারবে না। এরই অংশ হিসাবে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলেরই বিপুলসংখ্যক প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচনে নামলেও এখনই লাগাম টানেনি আওয়ামী লীগ।
কোনো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ বিজয়ী হতে না পারে, প্রতিটি আসনেই যেন উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে, তেমনটিই চায় ক্ষমতাসীন দলটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটের আমেজ ধরে রাখতে জোট শরিদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির নিয়েও কৌশলী ছিল আওয়ামী লীগ। দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটের মাঠে থাকতে দিলেও সবাইকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে, কেউ যেন নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ নষ্ট না করে।
অন্যদিকে ভোটের আমেজ ধরে রাখার পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।
জেলা, উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের যত কমিটি আছে সেইসব নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ইতোমধ্যে দলের প্রার্থী বা উপজেলা পর্যায় থেকে ইউনিট বা কেন্দ্র ভিত্তিক তালিকাও করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে পরিবার, প্রতিবেশী ও স্বজনদের যতটা সম্ভব ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
এমটিআই