ঢাকা : সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ে গত দুই মাসে বিএনপির আন্দোলন সফল নাকি ব্যর্থ এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
দলটির নেতারা বলছেন, তাদের এ আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু দলটির কর্মীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আন্দোলন সফল হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিভিন্ন সময় যা বলেছেন, তার প্রতিফলন আন্দোলনে নেই। আন্দোলনের দৃশ্যমান অগ্রগতিও নেই।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ আয়োজন করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। পরদিন হরতালের ডাক দেয় দলটি। এরপর ধাপে ধাপে হরতাল, অবরোধ, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
কিন্তু বিএনপি নেতারা যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম করার হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন, সেভাবে তাদের রাজপথে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। রাজপথ দখলে নিতে পারেননি দলটির নেতারা।
যদিও বিএনপি নেতাদের স্লোগান ছিল ‘দেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে’। বরং বেশিরভাগ নেতাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। বিএনপি কঠোর কর্মসূচির পরিবর্তে ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে প্রচার ও অসহযোগ কর্মসূচি পালন করছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর বিদেশিদের যে চাপ ছিল তার সুযোগও নিতে পারেনি বিএনপি। সরকার আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘রাজপথ দখলে নিলেই আন্দোলন সংগ্রাম সফল বলা যাবে এমনটা নয়। রাজপথে দখল ছাড়াই আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে আমাদের সাফল্য জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এটা আমাদের বড় সাফল্য।’
তিনি আরও বলেন, ভোটের দিন ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় থাকা গরিব মানুষগুলোকে হুমকি-ধমকি দেখানো হচ্ছে যে, তারা ভোট দিতে না গেলে তাদের কার্ড বাতিল করা হবে। এসব কিছুই আমাদের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাফল্য।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘আজকে সরকার একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে যেসব অনৈতিক কাজ করছে তা অতীতে করেনি। বিশেষ করে আসন বণ্টন নিয়ে বানরের পিঠা রুটি ভাগাভাগির মতো অবস্থা হয়েছে। এমনকি কে বিরোধী দল হবে তাও প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিচ্ছেন। এটাই আমাদের সফলতা।’
তিনি বলেন, সরকারের জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে গত দুটি সংসদ নির্বাচনের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে আসন ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে যা করেছে তা জনগণের কাছে হাস্যকর হয়েছে। এর বাইরে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তি জারি করিয়েছে এই বলে যে, প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর নির্বাচনী প্রচারণার বাইরে ভোটবিরোধী কোনো কর্মসূচি পালন করা যাবে না বলে সংবিধান-পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাও আমাদের অর্জন।’
বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকার ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করেও বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। এটাও দলটির অন্যতম বড় সাফল্য।
তবে বিদেশি চাপ কাজে লাগাতে না পারায় বিএনপির পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির এক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা। যার কারণে ভারতের কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছে।’
বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘রাজপথে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম এখনো চলমান। আন্দোলন সংগ্রামের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা প্রমাণের সময় এখনো আসেনি। এজন্য আমাদের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ আমাদের টার্গেট ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। এবার আমরা জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ভোট বর্জনের জন্য। আমাদের প্রত্যাশা ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোট হয়তো কাস্ট হতে পারে।’
অবশ্য বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে না নামার বিষয়ে সমমনা দলগুলোর সমালোচনা রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কিন্তু বিএনপি নেতারা কজন রাজপথে নামছেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রাজপথে নামছেন না। তাদের বেশিরভাগ নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা কবে রাজপথে বের হবেন? ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর?’
এভাবে চলতে থাকলে আন্দোলন সংগ্রামে সফলতা আসবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে বলে মনে করেন জামায়াতের এ নেতা।
বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা রাজপথে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনুপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনে হয় শীতনিদ্রায় গেছেন। তাদের রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। অথচ ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছিল রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া। কিন্তু এখন তারা আত্মগোপেন। এভাবে চলতে থাকলে আন্দোলন সংগ্রামে সফলতা আসবে না।’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘শত নির্যাতন ও চাপের মধ্যেও বিএনপি ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যায়নি। বরং তারা নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে জনগণের মধে লিফলেট বিতরণ করছে।’
রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘গত দুই মাসে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে আন্দোলন করছে তার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের দলের নেতারাই নামেন না সেখানে সাধারণ মানুষ কার সঙ্গে নামবে। জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতারা এখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে কাজ শুরু করেছেন। ভোট বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এখন তাদের আহ্বানে জনগণ কতটা সাড়া দেবে সেটা সময়ই বলে দেবে।’
এমটিআই