ঢাকা : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতা। সেই সঙ্গে থেমে নেই আচরণবিধি লঙ্ঘন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ বেশি। এসব ঘটনায় কোনো কোনো প্রার্থীকে করা হচ্ছে শোকজ। আবার কাউকে করা হচ্ছে জরিমানা। দুই-একটি মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাতেও বন্ধ হচ্ছে না সংঘাত-সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে জেল-জরিমানা দুই ব্যবস্থাই রয়েছে। তবে কেউ যখন তার চেয়েও গুরুতর অপরাধ করে ফেলেন, সে ক্ষেত্রে প্রার্থিতাও বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীরা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যান। ফলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোটেও আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ ফৌজদারি অপরাধের মতো ঘটনা ঘটছে।
তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত যত অঘটন ঘটেছে, সেই সব ঘটনাকে ছোটখাটো হিসেবেই দেখছে নির্বাচন কমিশন।
তাদের মতে, নির্বাচন ঘিরে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এর আগে নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেছিলেন, নির্বাচনী ডামাডোলে সবাই ব্যস্ত। প্রচার ঘিরে ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশে সব নির্বাচনে এ ধরনের ‘ঐতিহ্য’ রয়েছে, এটা ব্যতিক্রম না।
মোটাদাগে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন না প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
গত বৃহস্পতিবার এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী মাঠে আমরা অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা প্রার্থীদের সঙ্গে সভা করেছি। প্রশাসনের সঙ্গে সভা করেছি। তাদের কাছ থেকে খুব বেশি অভিযোগ আমরা পাইনি।’
তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে খুব বেশি ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। সিইসি আরও বলেন, ‘সহিংসতা একেবারে হয়নি, সে কথা বলছি না।’
নির্বাচনী আচরণবিধির ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, প্রার্থীরা নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই ধারায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করতে পারে নির্বাচন কমিশন। জেল-জরিমানার পাশাপাশি প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারে কমিশন।
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। তফসিল ঘোষণার আগেই অনেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রতীক নিয়ে সভা-সমাবেশ ও ভোট চেয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর আচরণবিধি লঙ্ঘন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে; বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ উঠছে।
নির্বাচনে নিজেদের শক্তি আর জনপ্রিয়তা দেখাতে গিয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারে বাধা দেওয়া, নির্বাচনী ক্যাম্পে গিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেওয়া, প্রতিপক্ষ ও ভোটারদের হুমকি, মারধর, হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা ও বরগুনার দুই নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশনে তলব করা হলেও শুধু জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে গেছেন তারা। তবে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে তাদের প্রার্থিতা কেন বাতিল করা হবে না, সেই ব্যাখ্যা চেয়ে তলব করেছিল কমিশন।
২৭ ডিসেম্বর প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে চিঠি দিয়েছেন কক্সবাজার-১ আসনের হাতঘড়ি প্রতীকের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক)। কক্সবাজার-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগে আনেন তিনি।
ভোট দিতে না গেলে ভাতা বন্ধের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পঞ্চগড়-২ আসনে নৌকার প্রার্থী রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে শোকজ করা হয়। পরে তিনি এই শোকজের জবাব দিয়েছিলেন।
১৯ ডিসেম্বর নৌকার বাইরে গিয়ে কেউ কোনো কথা বললে গলা নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন মাদারীপুর-২ (রাজৈর-সদর একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২৪ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আব্দুল হাই এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। ঝিনাইদহ-১ আসনের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে দুটি ঘটনায় মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে ইসি।
এদিকে ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন শতাধিক শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশন।
শুক্রবারও কয়েক প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিটির জন্য যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজদের নিয়ে নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে কমিশন।
তবে ইসির সূত্র জানায়, এসব কমিটি ঢাকা অঞ্চলে ৮৬টি, রংপুর অঞ্চলে ১৬টি, কুমিল্লা অঞ্চলে ৪১টি, ফরিদপুরে ১৭টি, চট্টগ্রামে ২০টি, সিলেটে ১৪টি, বরিশালে ২২টি, খুলনায় ১৭টি, রাজশাহীতে ৩৪টি ও ময়মনসিংহে ৩২টি শোকজ-তলব করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় আচরণবিধি লঙ্ঘন এমন একটা পর্যায়ে চলে যায়, যা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। নির্বাচন কমিশনের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তারা প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে, কারাদণ্ড দিতে পারে। তেমন কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা কমে আসত।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আচরণবিধি করা হয় যাতে নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ তৈরি হয়। কোনো প্রার্থী যেন ভোটের মাঠে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারেন। এ জন্য বিধিবিধানের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হয়। যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের ক্ষেত্রে বিধিবিধানের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে ইসিকে।
সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনের শুরু থেকে আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটছে। যারা ইতমধ্যে ভোটে অংশ নিয়েছেন, তাদের অনেকে তথ্য গোপন করেও বৈধ প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এসব অপরাধে কমিশন চাইলে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। কারণ নির্বাচন কমিশনের হাতে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে এবং এটা তারা নিজেরাই বলেছে। তাহলে কেন তারা করছে না? করছে না, কারণ তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে।’
তিনি মনে করেন, নির্বাচন কমিশন একটা ভোটের খেলার অয়োজন করেছে। ফলে প্রার্থীরা যে যেভাবে পারছেন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। এখানে যদি শক্ত বিরোধী দল থাকত, দেখা যেত আচরণবিধি ঠিকই বিরোধী দলের ওপর প্রয়োগ হতো।
এমটিআই