ঢাকা : বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ করা হবে। আগেভাগে এ নির্বাচনে ফলাফল আঁচ করা গেলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েই যাচ্ছে।
বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করেছে।
শনিবার (৬ জানুয়ারি) থেকে তারা দেশজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করবে।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। ট্রেনেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে স্বতন্ত্র (ডামি) প্রার্থী দাঁড় করানোসহ নানা কৌশল নিয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ আসনে আওয়ামী লীগের এসব প্রার্থীই ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার আভাস দিয়েছেন। ফলে এসব আসনে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর তৃতীয়বারের মতো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিএনপিসহ ইসির নিবন্ধিত ১৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বাইরে রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোমধ্যে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যেই ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা ভোটে জয় নিশ্চিত করেন। বাকি আসনগুলোতে ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৪০ ভাগের মতো।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রায় সব দল অংশ নিলেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যেই সেবার প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি করেছে ইসি।
এবার নির্বাচন কমিশন ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি থাকলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করা যাবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে গতকাল ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘নির্বাচনটা হতে দিন। গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা, সেটা বিদেশিরাই বলবে।
আমরা তো বলছি, ভোটার টার্নআউট, অংশগ্রহণ সন্তোষজনক হবে। এ দেশে একটা ভালো নির্বাচন হবে। প্রধান বিরোধী দল যেখানে নেই, এটা আমরা রিগ্রেট (অনুশোচনা) করি। বিএনপি থাকলে নির্বাচন আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতো– সেটা আমরা স্বীকার করি। তারপরও এ নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে।’
পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ৭ জানুয়ারির একতরফা ও ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে হাস্যরস এবং সমালোচনা চলছে। সরকার নিজ দায়িত্বে ও মরিয়া উদ্যোগে প্রতিদিন সেটিকে প্রহসন ও সহিংসতার নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ডামি প্রার্থী ও ডামি দল উৎপাদন করেই ক্ষান্ত হয়নি; এখন তারা নজর দিয়েছে জোরপূর্বক ডামি ভোটার সৃষ্টিতে।
নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, এ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯। এর মধ্যে নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯; পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৭৪১। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮৪৯ জন।
আজ ব্যালট পাবে ২৯৬৪ কেন্দ্র : এবারের নির্বাচনে মোট ৪২ হাজার ২৫টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্গম ২ হাজার ৯৬৪ কেন্দ্রে আজ শনিবার ব্যালট পেপার পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ইসি। বাকি ৩৯ হাজার ৬১ কেন্দ্রে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পৌঁছানো হবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবার ইসি ভোটের দিন সকালে ব্যালট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যালট পেপার পরিবহন ও বিতরণে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটের দিন রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সঙ্গে সকাল ৬টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করবেন। সকালে ব্যালট পেপার পরিবহনের বিষয়ে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবে।
গত ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ৩০০ আসনের তপশিল ঘোষণা করেন। পরে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের ভোট স্থগিত করা হয়।
এবার নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী আওয়ামী লীগের। দলটির প্রার্থীর সংখ্যা ২৬৬। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৭টি রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থী ১ হাজার ৫৩৪ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন আরও ৪৩৬ জন। ফলে ১ হাজার ৯৭০ জনের নাম থাকবে ব্যালট পেপারে। যদিও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের কয়েকজন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দের পরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচন উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এ সময় কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক্ষক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অভিন্ন কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন, দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে।
সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তঃজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৮ লাখ সদস্য মাঠে : সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৮ লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন। নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পৃথক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ জন আনসার সদস্য। বাকিদের মধ্যে রয়েছে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট আট দিন মাঠে থাকবেন তারা। আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ সময় লাইসেন্সধারীরাও আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবেন না।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আট বিভাগে ২ হাজারের বেশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে গতকাল শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছেন আরও ৬৫৩ বিচারিক হাকিম। বিচারিক হাকিমরা ভোটের আগে-পরে পাঁচ দিন দায়িত্ব পালন করবেন।
এর আগে সারাদেশে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন অপরাধে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের রেকর্ড সংখ্যক শোকজ, তলব ও জরিমানা করেন। এ ছাড়া এসব কমিটির সুপারিশে নিয়মিত আদালতে অর্ধশতাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
১৮৬ বিদেশিকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি : নির্বাচন দেখার জন্য যেসব বিদেশি আবেদন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১৮৬ জন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিককে অনুমতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের মধ্যে ১২৭ পর্যবেক্ষক ও ৫৯ জন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মী।
এ ছাড়া নির্বাচন দেখতে দেশি ২০ হাজার ৭৭৩ পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ৫১৭ এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।
২২ সদস্যের মনিটরিং সেল : নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে ইসি। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, মনিটরিং সেল শনিবার (৬ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত মোট ৭২ ঘণ্টা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার নির্বাচন : এ নির্বাচনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে ইসি। বিশাল এ বাজেটের বেশির ভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এমটিআই