ঢাকা : দেশে গত ১৪ বছরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত বিপুল উন্নয়ন হলেও সে তুলনায় সড়কে চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। বিশেষ করে ঈদ বা বড় কোনো উৎসবে ছুটির সময় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য হারে।
যারই ধারাবাহিকতায় ঈদুল ফিতর উদযাপন আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতে মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৪ জন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ১ হাজার ৪৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আর এবার ঈদুল ফিতরের আগের সাত দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ১২ দিনে সড়কে ৩৫০টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৬০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরও অন্তত ৫৪৪ জন আহত হয়েছে। অর্থাৎ ঈদযাত্রা ঘিরে সড়কে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২১ জন মানুষ নিহত হয়েছে। সেই সঙ্গে আহত হয়েছে আরও বহু মানুষ।
বিআরটিএর হিসাবে, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৩০শতাংশ। গত বছরের প্রথম তিন মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭টি এবং এতে ১ হাজার ৫১ জন নিহত ও ১ হাজার ৪৪০ জন আহত হয়।
প্রতিবারই ঈদের সময় রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের বড় একটি অংশ ঢাকা ছেড়ে বাড়িমুখী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল থেকে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি গিয়েছিল। সড়কে ঈদের আগে-পরে বাড়তে থাকে গাড়ির চাপ। এ সময় গণপরিবহনের বড় রকমের সংকট দেখা যায়। আর ঈদের দিন থেকে পরের কয়েক দিন সড়কও থাকে ফাঁকা।
এ সুযোগে পাল্লাপাল্লি করে গাড়ি ওভারটেক (পাশ কাটিয়ে আগে যাওয়া) করে চালকরা। ঈদের সময় অনেক ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছুটিতে থাকায় গাড়ির মালিকরা অনেক সময় গাড়ি চালান।
এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচলে বাড়তি চাপ থাকায় অনেক সময় চালকের সহকারীরা (হেলপার) চালায় গাড়ি।
অন্যদিকে যাত্রীর চাপ থাকায় নগরীর গণপরিবহনও উঠে যায় মহাসড়কে। সেই সঙ্গে অনেক মৌসুমি চালকও দূরপাল্লার গাড়ি চালায়। ঈদযাত্রার সুযোগে অনেক ফিটনেসবিহীন বাসও সড়কে দাপিয়ে বেড়ায়। এসব নানা কারণে ঈদে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল ফরিদপুরে দুর্ঘটনার কবলে পড়া বাসটিরও কোনো কাগজপত্র ছিল না বলে দেশ রূপান্তরকে জানান বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী।
তিনি বলেন, ‘ফরিদপুরে দুর্ঘটনায় পড়া বাসটির কোনো কাগজ ছিল না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ির জন্য সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ে। সড়কে থাকে পুলিশ। তারা যদি এসব মনিটরিংয়ে রাখে তাহলে তো এসব গাড়ি সড়কে চলাচল করতে পারত না।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালযয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঈদের সময় মানুষের যাতায়াত বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এখনো বাড়তি যাত্রী সামাল দেওয়ার মতো পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে সড়কে দেখা যায় গাড়ির সংকট। আর ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তো আছেই যাত্রীদের। সেজন্য পণ্যবাহী গাড়ি দিয়েও অনেকে যাতায়াত করে সড়কে। এ সময়ে যাত্রী পরিবহনে বহুমাত্রিক যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় সড়ক অনিরাপদ হয়ে যায়।’
সড়কে ঈদের আগের সাত দিনের তুলনায় ঈদের দিন থেকে শুরু করে পরের সাত দিন দুর্ঘটনা বেড়ে যায় উল্লেখ করে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঈদের ফাঁকা রাস্তায় ৫২ শতাংশ উঠতি বয়সী তরুণ মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালায়। তাদের কাছে গতি বাড়ানো এক প্রকার মাদকতা। সেসব মোটরসাইকেলের জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে ঈদের সময়।’
ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমানোর জন্য প্রথমেই পরিবহনের যে সংকট আছে সেটির সমাধান করতে হবে। সেই সঙ্গে কোনোভাবেই পণ্য পরিবহনের গাড়ি যেন যাত্রী বহন না করতে পারে। আর মহাসড়কে কোনোভাবেই ফিটসেনবিহীন বাস চলাচল করতে যাতে না পারে তা মনিটারিং করতে হবে। তাহলেই দুর্ঘটনা কমে আসবে।’
সার্বিক বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী বলেন, ‘ঈদে মানুষের যাতায়াত সংখ্যা বেড়ে যায়। সেজন্য এ সময়ে আমাদের মনিটরিং সবচেয়ে বেশি করা হয়। অনেক সময় ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করায় দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ফরিদপুরে গতকাল যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সে বাসটিরও কিন্তু কাগজ ছিল না। সড়কে থাকা পুলিশ যদি এসব বিষয় দেখত তাহলে এসব বাস সড়কে চলাচল করতে পারত না।’
নিরাপদ সড়কের জন্য পাঁচ বছর আগে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও দেশের সড়ক-মহাসড়ক শেষমেশ নিরাপদ করা যায়নি।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৯৫ জন।
তবে বিআরটিএর এ হিসাবের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের মিল নেই। গত বছর ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার একটা হিসাব প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কয়েক বছর পরপরই তারা এটা করে থাকে, যাতে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের হিসাব থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবারই দেখা যায়, সরকারের দেওয়া হিসাবের সঙ্গে তাদের দেওয়া হিসাবের বড় তফাত।
২০১২ সালে সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৩৮। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২১ হাজার ৩১৬। এ হিসাবটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালে এসে তারা আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ৩৯৬ হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এটি ২৪ হাজার ৯৪৪।
সর্বশেষ প্রতিবেদনটিতে মূলত ২০২১ সালের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি হিসাবে ৫ হাজার ৮৪ জন মানুষ মারা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে মারা গেছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জন।
সড়কে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এটা কমে আসছে। ২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে। যার মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কাও। বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনেজুয়েলার মতো ১০টি দেশ তো মৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঈদে সড়কে মুভমেন্ট (চলাচল) বেশি হয়। আর পরিবহন চালকরা বিরতিহীনভাবে বাস চালায়। অনেক ফিটনেসবিহীন বাসও দাপিয়ে বেড়ায় সড়কে। তাই ঈদের সময় সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।’
এমটিআই