ঢাকা : প্রতীক ছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগকে দলের ভেতর থেকেই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। দলের শক্তি যাচাই করার জন্য স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিলেও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের (এমপি) প্রভাব বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে কারণে তাদের সতর্ক করে বারবার নির্দেশনা দিতে হচ্ছে।
চার ধাপে অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেও মন্ত্রী-এমপি স্বজনদের প্রার্থী না করা ও পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন না দিতে কড়াভাবে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। কিন্তু তারা এই হুঁশিয়ারির পরোয়া করছে না। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।
টানা চতুর্থবার ক্ষমতাসীন দলটিতে এমন বিশৃঙ্খলার অন্তত চারটি কারণ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো এমপিদের দলীয় পদে না রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। দল ও সরকার আলাদা করার কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেনি।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দল থেকে সরকার আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভায় দুজন কেন্দ্রীয় নেতাকে রেখে সেই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করা হয়। ওই সরকারই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইন প্রণয়ন করে। সেই সঙ্গে এমপি বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কাউকে দলীয় পদ দেওয়া হবে না এই সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে দলটি।
আওয়ামী লীগই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাকে দল মনোনীত করবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অন্য কোনো দলীয় নেতা নির্বাচন করতে পারবে না। তাহলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথাও জানায় আওয়ামী লীগ।
গত ১৫ বছরে নেওয়া উল্লিখিত ওই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে না পারায় দলের ভেতরের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দ্বন্দ্ব-কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে; যা দেখা যাচ্ছে আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করতে না পারার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা দাবি করেন, দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। বড় বড় যেসব ক্ষোভ-বিক্ষোভ আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে বেশ খোরাক জুগিয়েছে এ চারটি কারণ এর অন্যতম।
বিভিন্ন পর্যায়ের এসব নেতা আরও বলেন, বিশৃঙ্খলা ধারাবাহিক রূপ নেওয়ায় উন্মুক্ত রাখা উপজেলা নির্বাচন দলের জন্য একধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া ছোট ছোট আরও অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে; যা আওয়ামী লীগকে সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করার অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে। এর আগে গত বছর ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হয়েছে তালহীন আওয়ামী লীগকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে রাজনীতির স্বার্থেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো সিদ্ধান্তই শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তবে আওয়ামী লীগে সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত সব নেতাকর্মীর কাছে শিরোধার্য।’
দলের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজনৈতিক দলের নিয়মিত কাজেরই অংশ। কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে সেই সিদ্ধান্ত অকার্যকর করা হয়।
তিনি বলেন, একটি সিদ্ধান্ত সব সময়ই ইতিবাচক হবে, সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। পরিবেশ-পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, তেমনি কিছু সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়েও আসতে হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আর ভেঙে দলে নানা অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ সেসব অসন্তোষ দলের অভ্যন্তরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
দলের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিশেষ স্বার্থ হাসিলের জন্য ১৫ বছরে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে সেখান থেকে সরে এসেছে ক্ষমতাসীন দল। এসব কারণে বিক্ষুব্ধ এই নেতা আরও বলেন, এমন অনেক সিদ্ধান্ত কেন্দ্র গ্রহণ করেছে, মাঠে সেটি দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে দুই রকমভাবে প্রযোজ্য হয়েছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহ প্রকাশ করে প্রার্থী হওয়ার শাস্তি কাউকে দিয়েছে, কাউকে দিতে পারেনি।
এ সময় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম পুরো আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন বলে এই নেতা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সারা দেশেই কমবেশি এমন দৃষ্টান্ত আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য করুণ পরিণতির কারণ হতে পারে। যদি সেই দলটি আওয়ামী লীগ হয়, সেটা আরও বড় দুঃসংবাদ বলা যায়। কারণ, রাজনৈতিক দল যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নানা দিক ভেবে নিতে হয়। রাজনীতি দাবার চালের মতো। চালে ভুল করলে দলকে ও জনগণকে তার মূল্য দিতে হয়। তারা বলেন, সব স্তরে দ্বন্দ্ব-কোন্দল সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ ভুগছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় খুব ভেবেচিন্তে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেশের ও দলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে ঠিক অকল্যাণও হতে পারে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দল ও সরকার আলাদা করার নীতি নিয়েছিল। কিন্তু দুজন কেন্দ্রীয় নেতাকে মন্ত্রী করে বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। দুজনকে মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে বাকি নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে থাকে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশ, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও কেন্দ্রীয় নেতাদের বাইরে রেখে মন্ত্রিসভা হয়নি, যা আওয়ামী লীগ শুরু করেছে। ওই নেতার দাবি, রাজনৈতিক মন্ত্রিসভা না হওয়ায় তখনকার সরকারে বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতি করে এমপি হওয়া নেতাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার ফলে রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দক্ষতার অভাবে ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রীয় কাজেও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন মন্ত্রিসভার সেই সব সদস্য।
এর ফলে বড় যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা হলো, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতিরিক্ত কাজের চাপ নিতে হয়েছে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ৪০টির অধিক জেলায় যিনি এমপি, তিনি ওই জেলায় দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদও পেয়েছেন। এমন দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনেও। যিনি সিটি, পৌরসভা, উপজেলার মেয়র ও চেয়ারম্যান, তিনি আবার ওই উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদও পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন আইনে নির্বাচন আয়োজন করলেও অধিকাংশ এলাকায় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতারা।
ফলে স্থানীয় নেতাকর্মীর চাপ, অসন্তুষ্টি এসব মিলিয়ে বিদ্রোহ প্রকাশ করে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করেছেন তারা। তাদের অনেকেই জিতেছেন কিংবা হেরেছেন। নির্বাচনের পরে সেই নেতাদের দলীয় পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে আবার অল্পসংখ্যক নেতাকে শাস্তির বাইরেও রাখা হয়েছে। এটিও দলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির রসদ জুগিয়েছে। যেমন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ওই সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তার মাকে মেয়র পদে বিজয়ী করেছেন।
এত বড় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে যুক্ত হলেও সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সব বিদ্রোহীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে দুর্বলতার পরিচয় দেওয়ায় দলীয় বিশৃঙ্খলার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা ও সুযোগ এখন কম বলেই তিনি মনে করেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসা রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে, সেখান থেকে বের হয়ে আসাও দলের নিয়মিত কাজেরই অংশ।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :