ঢাকা : দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উপজেলা পরিষদে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে এককাতারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বললেও প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপেও অনেকেই ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন। একইভাবে বিএনপি নির্দেশ দেওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেও কোনো কাজ হয়নি। দলটির অনেক নেতা নির্বাচন করছেন।
আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত ১৬ জন আত্মীয়স্বজন ভোটের মাঠে রয়েছেন। বিএনপির ৫০ জনের বেশি নেতা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি।
তবে দলীয় নির্দেশনা মেনে আওয়ামী লীগের অন্তত ৩০ ও বিএনপির ৪ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রত্যাহারকারীদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-রূপগঞ্জের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পাও রয়েছেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের তফসিল অনুযায়ী, গতকাল ছিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এ ধাপে ১৬১ উপজেলায় ভোট হবে আগামী ২১ মে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চেয়ারম্যান পদে চূড়ান্ত প্রার্থী ৬০৫ জন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন ১০৩ জন। বাতিল হয়েছে ২০ জনের মনোনয়ন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে চূড়ান্ত প্রার্থী ৬৯৪ জন। মনোনয়ন বাতিল হয়েছে ২০ জনের।
আর প্রত্যাহার করেছেন ৫১ জন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে চূড়ান্ত প্রার্থী ৫২৯ জন। মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন ২৩ জন আর বাতিল হয়েছে ৮ জনের।
আমাদের রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিসিবির পরিচালক গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পা নারায়ণগঞ্জের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন।
শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী টুসির আপন ছোট ভাই গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জামিল হাসান দুর্জয়।
তবে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় ভোট করছেন এ কে এম ফয়জুল হক রোম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার আপন চাচাশ্বশুর। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু জাহিরের স্ত্রীর বড় ভাই আক্তারুজ্জামান এবং হবিগঞ্জ-১ আসনের এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়ার সৎভাই রাজন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ভাতিজা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার মাঠে রয়েছেন। কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহাবুবউল আলম হানিফের চাচাতো ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা নির্বাচন করছেন।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় মাঠে রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রাসেদ প্রধান। তিনি সাবেক রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নূরুল ইসলাম সুজনের ব্যক্তিগত সহকারী।
এ ছাড়া গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি মুরাদ কবীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাতিজা। সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও লালমনিরহাট-২ আসনের বর্তমান এমপি নুরুজ্জামান আহম্মেদের আপন ভাই বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহাবুবুজ্জামান আহম্মেদ ও এমপির ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহম্মেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে।
রংপুরের মিঠাপুকুর-৪ আসনের এমপি জাকির হোসেন সরকারের মামাতো ভাই শাহ সাদমান ইশরাক ফকির, পাবনায় চাটমোহর উপজেলায় স্থানীয় এমপি মকবুল হোসেনের বড় ছেলে গোলাম হাসনায়েন রাসেল মাঠে রয়েছেন। তিনি ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী প্রিয়া আগরওয়ালা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালার ছেলের বউ। নাটোরের লালপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র এমপির ভাতিজা শামিম আহমেদ সাগর প্রার্থী হয়েছেন। রাজবাড়ী বালিয়াকান্দি উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী এহছানুল হাকিম রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমের চাচাতো ভাই। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. জাফর উল্লাহ স্থানীয় সাংসদ আলী আজম মুকুলের বড় বোনের জামাই। এ ছাড়া বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ, ভোলা সদর আসনের এমপি তোফায়েল আহমেদের ভায়রা ভাই। শরীয়তপুর-১ আসনের এমপি ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতো ভাই বিল্লাল হোসেন দীপু মিয়া ও চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী পেন্সি বেগম সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে মাঠে রয়েছেন শিল্পমন্ত্রীর ছোট ভাই নজরুল মজিদ মাহমুদ স্বপন।
এদিকে বিএনপির কেন্দ্রের নির্দেশনা মেনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের খবর পাওয়া গেছে। বিএনপির দপ্তরের সূত্র বলছে, পঞ্চগড়ে বোদা উপজেলায় বিএনপির তিন নেতা চেয়ারম্যান পদে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব লাইলী বেগম ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আসাদুল্লাহ নির্বাচনের মাঠে ছিলেন। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে উপজেলা যুবদল সভাপতি কামরান জাদিদ মুকুট ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আহসান উল্লাহ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন।
দলের কঠোর নির্দেশনার পরও যারা নির্বাচনের মাঠে থেকে গেছেন প্রথম ধাপের মতো, তাদের তালিকা করছেন বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপে অন্তত ৩৩ জন নেতা শুধু চেয়ারম্যান পদেই নির্বাচন করতে ভোটের মাঠে রয়েছেন। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে বিএনপির ৫০ জনের বেশি নেতা ভোটের মাঠে রয়েছেন।
দলটির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, প্রথম ধাপের নির্বাচনে যারা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীন ছিল দলটি। এ কারণে প্রথম ধাপের প্রার্থীদের ব্যাপারে দল কিছুটা সময় নিয়েছে এবং সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় তাদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত একযোগে ৭৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন, তাদের নামের তালিকা করতে বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ তালিকা তৈরি শেষ হতে পারে বলে দলটির দপ্তর থেকে জানানো হয়। পরে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে। সন্তুষ্ট না হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমটিআই