ঢাকা : কোরবানির গরু ও সারা বছরের মাংসের চাহিদা মেটাতে একসময় ভারতের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীলতা ছিল। তবে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের পর থেকে সরকারি-বেসরকারি ও স্থানীয়ভাবে পশু উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাত্র এক দশকেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন সারা বছরের মাংস ও কোরবানির চাহিদা মিটছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়েই। তবে এজন্য চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। করপোরেটদের হাতে গো-খাদ্য ও গবাদি পশুর প্রজননব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রস্তুত কোরবানির পশু। এবার কোরবানির জন্য প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে। সরকারি হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবার ২০ লাখের বেশি গবাদি পশুর জোগানও রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর বেচাকেনাও শুরু হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত পশু থাকার পরও জনসাধারণকে আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে।
খামারিরা জানিয়েছেন, করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে থাকা গো-খাদ্য এবার ২৫-৩৫ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হয়েছে। ফলে পশু পালন ব্যয় বেড়েছে।
শুধু খাবার নয়, গরুর বাছুর উৎপাদনও করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। একটা সময় গবাদি পশুর সিমেন বা বীজ আমদানি করা হতো। তবে গেল কয়েক বছর থেকেই গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজননে বড় সাফল্য দেখা গেছে। দুই যুগে এ অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার দখল করে আছে।
খামারি ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৪ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশে গবাদি পশু পাচারের বিরুদ্ধে দমন অভিযান শুরু করার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুগ্ধ ও গবাদি পশু মোটাতাজাকরণে বিনিয়োগ বেড়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারত থেকে গবাদি পশুর সরবরাহ কমে যায়, যা আগে বাংলাদেশের জন্য বছরে ২০ লাখ গবাদি পশুর উৎস ছিল।
ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে গরুর মাংসের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে দেশে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ২৮০-৩০০ টাকা, যা এখন ৭৫০-৮০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মাংসের ভালো দাম ও নিশ্চিত মুনাফার কারণে গরুর খামারে যুবকরা, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, যা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
স্থানীয়ভাবে গবাদি পশু উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিসেস (ডিএলএস) আগ্রহী কৃষক ও খামারিদের প্রশিক্ষণ দেয়। এ ছাড়া সরকারের স্বল্প সুদের সহজ ঋণ এ খাতটির বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। বর্তমানে দেশে ব্যক্তি ও খামার মিলিয়ে প্রায় আট লাখ খামারি রয়েছেন, যারা দুধ ও মাংস উৎপাদন করছেন। বেশিরভাগ খামারি কোরবানির বাজার টার্গেট করে তিন-পাঁচ মাসে গরু মোটাতাজাকরণের সময় বেছে নেন।
খামারিরা জানিয়েছেন, পশু পালনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যের উচ্চমূল্য। গো-খাদ্য উপকরণের একটি বড় অংশই আমদানিনির্ভর। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গম ও সয়াবিন, দুটিই আমদানি করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম গত বছর বাড়তি থাকলেও এখন তা অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আমদানিকারকদের উচ্চ মুনাফা প্রবৃত্তির কারণে দেশে গো-খাদ্যের দাম বেড়েই চলেছে।
গো-খাদ্যের প্রধান উপকরণ গম, ভুট্টা, সয়াবিন, সরিষা, ভুসি। ভুসি ছাড়া অন্য সব উপকরণই আমদানিনির্ভর।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গো-খাদ্যের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করে দেশের প্রায় ৩০০ কোম্পানি। তবে এর মধ্যে ১০টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান সিংহভাগ আমদানিতে জড়িত। এদের মধ্যে ফ্রেশ, তীর, আবুল খায়ের, আকিজ, ইফাদ, যমুনা, স্কয়ারসহ ১০ কোম্পানির হাতে গো-খাদ্য উপকরণের বাজার ৫০ শতাংশের বেশি। মূল্য নির্ধারণে এসব কোম্পানিই মুখ্য ভূমিকা রাখে। গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন খামারিরা।
বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল তিন বছরের ব্যবধানে গো-খাদ্যের সব উপকরণের দাম ৬০ থেকে ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে বর্তমানে কাজী ফার্মের ২৫ কেজি বস্তার ডেইরি ক্যাটেল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ টাকায়, যা তিন বছর আগেও বিক্রি হয়েছে ৭৫০ টাকায়।
এ ছাড়া এসিআইর ২৫ কেজির গো-খাদ্য বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়, যা তিন বছর আগে ছিল ৮৫০ টাকা। আড়িয়ার বিট ক্যাটল গোল্ড বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৩৭ টাকা, যা তিন বছর আগেও বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা। আর এমপি ডেইলি ক্যাটল ফিড বিক্রি করছে ১ হাজার ৩০ টাকা, যা বছর তিনেক আগেও ছিল ৬৮০ টাকা।
কোম্পানিগুলো যে বেপরোয়ারভাবে খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে তার এক বড় উদাহরণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) পরিসংখ্যান থেকে। সংস্থাটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫ বছরের ব্যবধানে ফিডে ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামালের দাম গড়ে ৭৫ থেকে ১৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ফিড উৎপাদনে অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামালের মধ্যে সব থেকে বেশি মাছের তেল ১৪৪ শতাংশ, সয়াবিন ৮৫ শতাংশ, সয়াবিন তেল ১৩২ শতাংশ, ফিশমিল ৯৫ শতাংশ, ডিএলএম ৭৬ শতাংশ ও সাদা আটায় ১১৭ শতাংশসহ অন্যান্য উপদানের দাম বেড়েছে রেকর্ড গড়ে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রাণী উৎপাদন বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গরু উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার। আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার বেশি।
একইভাবে মহিষ উৎপাদন ৮ হাজার বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয়েছে ১৫ লাখ ১৬ হাজার, ভেড়া উৎপাদন ৫৩ হাজার বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয়েছে ৩৮ লাখ ২৭ হাজার ও ২ লাখের কিছু বেড়ে ছাগল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৪৩ হাজার।
এ বিষয়ে খামারিদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর হিসাব কোন পদ্ধতিতে করে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও হিসাবটা যে একেবারে ভুল, তা নয়। এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বিগত বছরগুলোতেও আমরা এটা দেখেছি। সেই মোতাবেক দেশে এবার চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পশু রয়েছে। ফলে গতবারের চেয়ে দাম কম থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও খাবারের দাম বাড়ায় এবারে খামারিদের ২০ শতাংশের বেশি খরচ বেড়েছে। তার একটা প্রভাব কোরবানির পশুর হাটে দেখা যাবে। এজন্য এবার খামারিরা লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন।’
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে প্রজননক্ষম প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ গাভি ও বকনা (মাদি বাছুর) রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ সিমেন প্রয়োজন হয় এই গাভি ও বকনার জন্য। কিন্তু চাহিদার প্রায় অর্ধেকের কম সিমেন উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫ লাখ ডোজ সিমেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের সিমেন উৎপাদন সক্ষমতা ৫ লাখ কমে ৪০ লাখে নেমেছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেশিরভাগই উৎপাদন করে বেসরকারি খাতের আটটি প্রতিষ্ঠান ও দুটি এনজিও। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ৬৫ লাখ সিমেন উৎপাদন হয়।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিমেন উৎপাদন করে ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন এন্টারপ্রাইজ, এসিআই অ্যানিমেল জেনেটিকস, আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড, ইজাব, লাল তীর, অ্যালায়েন্স ও ঠাকুরগাঁও ডেইরি লিমিটেড। এ ছাড়া সজাগ (সমাজ ও জাতি গঠন), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) ও সমবায় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা সিমেন উৎপাদন করছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিমেন উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন এন্টারপ্রাইজ, যেটি বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ সিমেন উৎপাদন করে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এসিআই অ্যানিমেল জেনেটিকস বছরে প্রায় ১৭ লাখ সিমেন উৎপাদন করতে পারে। আমেরিকান ডেইরি প্রতি বছর সিমেন উৎপাদন করে ১৫ লাখ।
এ ছাড়া ইজাব ৮ লাখ ও লালতীর বছরে ৫ লাখ সিমেন উৎপাদন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে সজাগ, সাদেক অ্যাগ্রোসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান সিমেন উৎপাদন করে থাকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, ‘একটা সময় আমরা সিমেন আমদানি করতাম। কিন্তু এখন আমাদের সক্ষমতা বাড়ায় তা আর আমদানি করতে হয় না। দুই যুগে এ অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।’
বরিশালের বাবুগঞ্জের খামারি রইস উদ্দিন বলেন, গেল কয়েক বছরের ব্যবধানে খামারিদের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। শুধু গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যায়, গো-খাদ্যের দাম গড়ে ২৫-৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে কর্মচারীর খরচ ছাড়া ফিডে ১৪ দশমিক ৮১, ভুসিতে ৩৮ শতাংশ, খড়ে ৬০ শতাংশ, ঘাসে ৪২ শতাংশ এবং ধান, ভুট্টা ও গমমিশ্রিত খাবারের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত। সেই হিসাবে এবার ছোট থেকে মাঝারি বা বড় আকারের গরুতে গড়ে অন্তত ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি বেড়েছে। তবে বাড়তি খরচ হলেও গরুর দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
গত আট বছরের বেশি সময় গরু পালনে যুক্ত বগুড়ার খামারি শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, খাদ্যের বাড়তি দামের কারণে পশু পালন চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
তবে খাবারের বাইরেও ছোট খামারিদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এর বাজার। ট্রেডার্স ও মধ্যস্বত্বভোগীরা সুসংগঠিত হওয়ায় বাজারে ছোট খামারিদের সরাসরি প্রবেশাধিকারে বাধা রয়েছে। যার কারণে সরাসরি ক্রেতার কাছে গরু বিক্রিতে ছোট খামারিদের সংগ্রাম করতে হয়। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই