ঢাকা : রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে এক ভ্যান চামড়া নিয়ে পুরান ঢাকায় পোস্তায় আড়তে এসে ইকবাল হোসেন গতবারের চেয়ে কিছুটা বেশি দাম পেয়েছেন, আবার হতাশ হয়েছেন।
তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার বাজার একটু ভালো মনে হইছিল। কিন্তু আমার চামড়া বড়। দাম আরও বেশি আশা করছিলাম।
একেকটি চামড়ার দাম ১২০০ টাকা করে চাইছিলেন ইকবাল। কামাল অ্যান্ড সন্সের মালিক কামাল উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার হোসেন দাম বলেন ৭০০ টাকা। পরে দামাদামি করে দাম ঠিক হয় ৮৭০ টাকা।
ইকবাল বলেন, গতবার বিক্রি করছিলাম ৭৫০ টাকায়। ক্রেতা আনোয়ার হোসেনও বললেন, মালের রেট গতবারের চেয়ে একটু বেশি আছে।
তবে ডেমরা দারুল উলুম শান্তিবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক তরিকুল ইসলাম ফাহাদের অভিজ্ঞতা উল্টো।
তিনি বলেন, ৮০০ টাকা করে এবার বিক্রি করেছি। গতবারই তো ৮৮০ করে বিক্রি করেছি।
কয়েক জায়গায় তো দাম ভালোই দেখা যাচ্ছে- এ কথার বিপরীতে তিনি তরিকুল বলেন, আমরাও আশাবাদী ছিলাম দাম ভালো পাব, কিন্তু পেলাম না।
এই মাদ্রাসা শিক্ষক বিক্রি করেছেন মো. ইউনুস নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি পূর্ব পরিচিত। তাই অন্য কোথাও দাম যাচাই করেননি।
এবার ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা বেড়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় কিনবেন; গত বছর এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গত বছর যা ৪৭ থেকে ৫২ টাকা ছিল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি বছর পশুর চামড়ার যে দর ঘোষণা করে, সেটি ট্যানারির জন্য। সেই দর পাইকারি বাজারে নির্দেশক হতে পারে, কিন্তু সেই বাজারে এই হিসাবে বিক্রি হয় না।
মাঝারি আকারের গরুতে ২০ থেকে ২৫ বর্গফুট চামড়া থাকে। পোস্তায় কাঁচা চামড়া কিনে সেগুলোতে লবণ মিশিয়ে বিক্রি করা হবে ট্যানারিতে। লবণ মেশানোতেও একটি খরচ আছে।
তবে পোস্তায় আসা বিক্রেতাদের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে ধারণার অভাব আছে। সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজার দরের পার্থক্য দেখে ‘ন্যায্য দাম’ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকে।
খিলগাঁও থেকে ২৫০ টি চামড়া আসা আরিয়ান শিশির নীল বলেন, বর্গফুটের কোনো হিসাব নাই এখানে। সংখ্যা হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকারের নিয়ম মানলে তো টাকা অনেক হয়ে যেত।
পোস্তায় কয়েক ঘণ্টা ঘুরে দেখা গেল, গরুর চামড়ায় ছিদ্র থাকলে সেগুলো নিতে চায় না আড়ত, অনুরোধ করলে দাম দেয় ৪০০ টাকার মত।
মাঝারি থেকে বড় গরুর চামড়াদেখা গেছে ৭৮০ থেকে ৯০০ টাকার ভেতর। এক ব্যবসায়ী অবশ্য এক হাজার টাকাতেও কেনার দাবি করেছেন।
গত কয়েক বছরের মত এবারও খাসির চামড়ার চাহিদা নেই, নিতে চাইলেও ১০ টাকা করে দাম বলা হচ্ছে আড়ত থেকে।
পূর্বাচল থেকে গুলশান-২ নম্বরে পিকআপে ১২০ টি চামড়া নিয়ে এসেছেন মাসুদ আলম। ব্যবসায়ী কাউসার আহমেদ বললেন, সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকা করে দেওয়া যাবে।
কিন্তু মাসুদ রাজি হননি। তিনি বলেন, এই গাড়ির আগের ট্রিপে ৭২টি চামড়া এনে দাম পেয়েছি ৯০০ টাকা করে। এখন কমিয়ে বলছে। আর কিছু মাল কাটাছেঁড়া ও ছোট, সেগুলো ৪০০ করে ধরছে।
মাসুদ এবার ৫০০ থেকে ৬০০ গরুর চামড়া কিনেছেন। দাম পড়েছে গড়ে ৭০০ টাকার মত।
গত বছর কোরবানিতে চামড়া কিনে দুই লাখ টাকা লোকসান হলেও এবার মুনাফার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি।
আশা করি লস খাব না, বাজারও ডাউন হবে না, বলেন মাসুম।
পোস্তার গুদাম মালিক কাউসার আহমেদ গুলশান এলাকা থেকে নিজেরাই চামড়া কিনেছেন। তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবারের দাম একটু বেশি। আমরা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় মাল নিয়েছি। এখন সেগুলোতে লবণ দেওয়া হবে, একেক চামড়ায় ৫ থেকে ৭ কেজি লবণ দিতে হয়।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সমিতি বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব উদ্দিন বলেন, চামড়া কেনা হচ্ছে, লবণজাত করার জন্যে যে যেখানে পারছে সেখানে পাঠাচ্ছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে আবার কিনেও আনছে। এখন পর্যন্ত ভালো আছে। বাকি সময়টা বোঝা যাবে।
তার তথ্য চলছে, চামড়া কেনার পর প্রতিটির পেছনে ২৯০ টাকার মত খরচ হবে। সরকার যে দাম ঠিক করেছে, সেখান থেকে এই টাকাটা বাদ দিয়েই হিসাব করে
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, সারাদেশেই আমাদের মনিটরিং টিম কাজ করছে। পোস্তায় মন্ত্রণালয়ের ৪/৫টি দল কাজ করছেন। কোথাও কোনো সমস্যা নেই, সব কিছু ভালোভাবে হচ্ছে।
কত চামড়া এবার?
কোরবানির সংখ্যা নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য তুলে ধরে আফতাব উদ্দিন বলেন, সারাদেশে এবার ১ কোটি ৫ লাখের মত পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় আনুমানিক ৯ লাখ পশু কোরবানি হয়।
সরকার দাম বাড়ানোয় ‘ভালো’ ফল পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই উৎসাহ, উদ্দীপনা পাচ্ছে।
আড়তদার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, দাম তো আমরা মোটামুটি দিচ্ছি। আটশ’, নয়শ, এক হাজার এ-রকম দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে আমদানি এবার কম, এটাই সমস্যা।
এবার নাকি ঢাকার বাইরের চামড়া নরসিংদী, কুমিল্লায় হয়ে ঢুকতে দেয়নি। বাকিটা কাল বোঝা যাবে।
ব্যবসায়ী আনোয়ারুল ওহাব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তারিক ইবনে আনোয়ার বলেন, কাঁচামাল (চামড়া) মাঠ পর্যায়ে আছে এখনও; সংগ্রহ চলছে। আড়তে আসার পর দাম নির্ধারণ হবে।
পোস্তায় ভিড় কম কেন : ব্যবসায়ীরা জানালেন, পোস্তায় ঈদের দিন কয়েক বছর আগে যে ভিড় হত, সেই তুলনায় এবারের চিত্র ব্যতিক্রম। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা এখানে কমই এসেছেন।
আড়তদার ও বিভিন্ন দোকানিরা জানালেন, গত বছর সন্ধ্যা সাতটার সময় পা ফেলার জায়গাও ছিল না।
কারণ হিসেবে উঠে, সাভারের হেমায়েতপুরে বেশিরভাগ আড়ত স্থানান্তর হয়েছে।
পোস্তায় উত্তরা ব্যাংকের সামনের পান বিক্রেতা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বাজার তো নষ্ট হইয়া গেচে। মাল ই তো নাই। আগে হাঁটা যাইত না।
কামাল অ্যান্ড সন্সের আড়তের মালিক কামাল উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, পোস্তায় আগে তিনশর মত আড়ত আছিল, এখন ৪০ টাও নাই। হেমায়েতপুর হইয়া গেচে আড়াইশ আড়ত। এখানের ব্যবসা নষ্ট হইয়া গেচেগা।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সমিতির সভাপতি আফতাব উদ্দিন বলেন, পোস্তার চেয়ে বেশি আড়ত বর্তমানে হেমায়েতপুরে। পোস্তার টার্গেট থাকে অনেক। আগেও তিন লাখের বেশি লবণজাত হত। গতবার ১ লাখের কাছাকাছি ছিল, এবারও এক লাখের মত হতে পারে বা কমই হবে।
দাম নির্ধারণ ছাড়াই চামড়া গুদামে : পোস্তায় হাজী সমির উদ্দিনের গুদাম রয়েছে আটটি। প্রতিষ্ঠানের নাম সমির-হানিফ এন্টারপ্রাইজ। এবার আড়াই লাখের চামড়া কেনার আশা করছেন তিনি।
একটি গুদামে চামড়া ঢুকছে ২৪ টি মাদ্রাসা থেকে।
সমির উদ্দিনের ছেলে জিয়া উদ্দিন আনাস বলেন, মাদ্রাসার লগে কন্ট্রাক্ট হইচে, সেইগুলো আনতাচে। তাদের সঙ্গে এখনও দাম ঠিক হয় নাইক্কা। ঈদের পরে দাম ঠিক অইব। আমরা যেমন দামে বেচমু একটু লাভ রাইক্কা তাদের টাকা দিয়ে দিমু।
গুদাম ব্যবস্থাপক বললেন, রাত দুইটার পরের মালে পচন ধইরা যায়। তাই দাম কম ধরা হয়। সেগুলোই প্রচার অয় বেশি। বিকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যে মালগুলো আসে এগুলোর দাম ভালো।
লালবাগের জামিয়া কুরআনিয়া মাদরাসার শিক্ষক মো. ইসহাক ১১০০ চামড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, গতবারের মতই দাম যাইব মনে হইতাছে। গতবার ৮০০র মত করে গেছে।
এমটিআই