ঢাকা : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর অন্যতম তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি বহুদিন ধরেই ঝুলে আছে। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি গিয়েছিলেন ভারতে টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে। কিন্তু এবারও তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি; বরং ভারত তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের মহাপরিকল্পনার বিষয়ে আগ্রহী বেশি।
গত শনিবার দিল্লিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে নরেন্দ্র মোদি জানান, পানিবণ্টন চুক্তি নয়, তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে শিগগিরই বাংলাদেশ যাবে ভারতের একটি কারিগরি দল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের এমন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল কাঙ্ক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। আর চুক্তি ছাড়া ভারতের এই মহাপরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।
পাশাপাশি তারা বলেন, ভারতের মহাপরিকল্পনায় আগ্রহ থাকলেও দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আরও দৃঢ় রাখতে এ চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করাই ভালো। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু খরার সময় পানি না পেলে এই অঞ্চলে বিপর্যয় নেমে আসবে।
এ ব্যাপারে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘তিস্তা বিষয়ে কিছুদিন আগে চীন প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত এতে সরাসরি না হলেও এক রকমভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। ভারত বলেছিল, তারাই করে দিতে পারে। তিস্তার যে অংশ বাংলাদেশে, সেই অংশের পানির ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে দুই দেশ কারিগরি কথাবার্তা বলবে। কিন্তু এ প্রস্তাব আমার কাছে মোটেও সঠিক মনে হয়নি।’
এ ব্যাপারে রাজনীতিকদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘পানির ব্যাপারে রাজনৈতিক মহল খুব একটা সোচ্চার নয়। আমাদের রাজনীতিক ভারতের কাছে কাঁচা মরিচের জন্য আবেদন করেন, পেঁয়াজের জন্য আবেদন করেন, কিন্তু তাদের পানির জন্য সোচ্চার হতে দেখি না। পানির জন্য আবেদন করেন কী?’
আইনুন নিশাত বলেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি থেকে পুরোপুরি সরে এসে এবার মহাপরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছে ভারত।’ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৫ বছরের সেই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। নতুন সরকার গঠন করা দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের কল্যাণে টেকসই সহযোগিতায় ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে। তাই মনে করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে দুই দেশের এই সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে।
দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত ইস্যু, বিশেষ করে অভিন্ন নদীর পানি সমস্যা, সীমান্ত হত্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে নতুন নতুন চুক্তি হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক যত ভালো হবে, ততই দুই দেশের নাগরিকদের জন্য স্বস্তির। তবে এর মধ্যে ভারত বড় দেশ ও তাদের অর্থনীতির আকার বড়। অনেক বিষয়ে ঢাকাকে ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেদিক থেকে সম্পর্ক গভীর রেখেই দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর সমাধানে আসা উচিত। এবারের সফরে নতুন কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে। এসব চুক্তির পাশাপাশি দুই নেতার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের একটা অংশ থেকে আরেকটা অংশে রেলওয়ে সংযোগ চালু করতে দুই নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
ট্রানজিট চালুর পর ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারত প্রবেশ করবে। পরীক্ষামূলকভাবে আগামী মাসেই বাংলাদেশ দিয়ে ভারতের রেল চলবে। রেলের ট্রানজিটের বিষয়ে নিরাপত্তা ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চুক্তিগুলোতে অবশ্যই দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। কারণ এবারের সফরটি মূলত রাজনৈতিক সম্পর্ককে ঝালাই করার সফর। নরেন্দ্র মোদি শপথ অনুষ্ঠানেই বলেছিলন, প্রতিবেশী নীতি এবার তার সরকারের কাছে গুরুত্ব বেশি পাবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের যেকোনো সফরেই কিছু কমন ইস্যু থাকে। এর মধ্যে পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, পণ্যের আমদানি, ভারতের ভিসা সহজ এসব। আর এর মধ্যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যেহেতু একধরনের আলোচনা হয়েই আছে, তাই এখন সবাই চায় চুক্তি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চুক্তির বদলে কথা হচ্ছে প্রকল্প পরিকল্পনার নিয়ে।
তিনি বলেন, ‘পানিবণ্টন চুক্তির বিকল্প কখনো মহাপরিকল্পনা হতে পারে না। আর নতুন করে ডিজিটাল ইস্যু, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল যুক্ত হয়েছে। রেল ট্রানজিট। বাংলাদেশর ভূখন্ড ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধার বিষয়টিও বিগত কয়েক বছরের। কানেক্টিভিটি বাড়ার ফলে অবশ্যই দুই দেশ সমানভাবে উপকৃত হবে। বাংলাদেশও তাদের ন্যায্য হিস্যার বিষয় মাথায় রেখেই প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসস্পর্ক বজায় রাখবে।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তা হয়নি।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বর্তমান পদ্ধতিতে ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশি চালক তা চালিয়ে আনেন। ফেরার সময়েও একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
এমটিআই