• ঢাকা
  • বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১
তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলার নয় বছর

কেউ খবর নেয়নি নিহত সানজু ও জামিলের পরিবারের 


বিশেষ প্রতিবেদক জুলাই ১৭, ২০২৪, ০৭:৫৫ পিএম
কেউ খবর নেয়নি নিহত সানজু ও জামিলের পরিবারের 

ঢাকা : বছর ঘুরে মহররমের মাস বা আশুরা আসলেই হোসেনীদালান থেকে তাজিয়া মিছিল বের করেন সিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। আর সেই তাজিয়া মিছিল দেখলেই আমার বুকটা হাহাকার করে উঠে। তখন আমি আমার সানজুর জন্য পাগল হয়ে যাই। কই আমার সানজু তো আর সিয়াগো তাজিয়া মিছিল থাইক্কা ফিরা আইলো না। মিছিল গেল , কিন্তু আমার সানজুতো আর আমার বুকে ফিরা আইলো না। আজ নয় বছর হলো আমার বুকের ধন আল্লায় নিয়া গেছে। এরপর থেকে এতদিন পার অইলো, কেউ আমাগো খোঁজ খবর নেয় না। এমন ভাবেই বিলাপ করছিলেন তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় নিহত স্কুল ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন সানজুর মা রাশেদা বেগম।    

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন,  গত ২০১৫ সালে পবিত্র আশুরার আগের রাতে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হোসেনি দালানে বোমা হামলায় নিহত হয় তাঁর ছেলে স্কুলছাত্র সাজ্জাদ হোসেন সানজু ও ক্ষুদে ব্যবসায়ী (তিলের খাজা বিক্রেতা) জামিল হোসেন (ওই হামলায় সাজ্জাদ ছাড়া আরও একজন নিহত ও শতাধিক লোক আহত হন। এঘটনায় গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের আঘাতে আরো শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আহতদেও মধ্যে সিংহভাগ সিয়া সম্প্রদালের লোকজন। 

কেরানীগঞ্জের খোলামুড়া চৌরাস্তার পাশে হাসেম মিয়ার বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন  সানজুর মা রাশেদা বেগম।  তার আরো এক ছেলে সোহেল তার পরিবার নিয়ে অবসবাস করছেন। গত সোমবার বিকেলে তাঁদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সাজ্জাদের মা রাশেদা বেগম ঘরের কোণে বসে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন। পাশে সাজ্জাদের বাবাও অশ্রুসিক্ত। বাবা সাংবাদিক দেখে আহাজারি করতে থাকেন। তিনি বলেন, আমার সানজু বেঁচে থাকলে এতদিনে কত বড়ই না হতো।  কেরানীগঞ্জের চড়াইল নুরুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল সানজু। 

সাংবাদিকদের আগমন এবং কান্নার শব্দ শুনে প্রতিবেশী নাসির অনেকটা ক্ষোভের বলেন, কাল বুধবার পবিত্র আশুরা। তাঁর ছেলের মৃত্যুর নয় বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এই নয় বছরে কেউই তাঁদের খবর নেয়নি। তাঁরা কেমন আছেন জানার প্রয়োজন মনে করল না কেউ। তিনি বলেন, ‘যহন পোলার কথা মনে হয় তহন পোলার ছবি দেখি। সব সময় পোলার ছবি পকেটে লইয়া কামে যাই। সানজুর ছবি দেখি মনে শান্তি পাই।

সাজ্জাদের মা রাশেদা বেগম বলেন, ‘বড় আশা ছিল পোলা লেখাপড়া কইরা বড় চাকরি পায়া আমগো কষ্ট দূর করব। অহন আমগো কে দেখব কে খাওয়াইবো?’

ওই হামলায় সাজ্জাদের বড় ভাই মো. রাশেদের স্ত্রী সুমি বেগম, মেয়ে স্নেহা (১১), ছেলে শিহাব (৫) ও শাশুড়ি আয়েশা বেগমও (৪৮) আহত হন। ভাই রাশেদ জানান, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সুমি বেগমের পায়ে এখনো স্প্রিন্টার রয়েছে। টাকার অভাবে স্প্রিন্টার বের করতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমি যে বেতন পাই তাতে সংসারই চলে না। চিকিৎসা করব কী দিয়ে?।

এদিকে তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় স্প্রিন্টারের আঘাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জামিল হোসেন। জামিল ভ্রাম্যমান হকার ছিলেন। তিলের খাজা বিক্রি করতেন তিনি। তার বাসা লালবাগের  ইসলামবাগে। তার স্ত্রী এক ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। সেখানেই ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার ছেলে এবং মা মাজেদা বেগম বাসার সামনে ফুটপাতে কাঁচা তরি তরকারি বিক্রি করতেন। এ আয় দিয়ে তাদের অভাব অনটনের সংসার কোনো রকম চলে যেত। 

মা মাজেদা বেগম ও জামিলের স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ে সাংবাদিক দেখে বলেন,  লেইখ্যা কি অইব। বাবা মারা গেছে প্রায় নয়-দশ বছর। এতদিন আমরা বাইচা আছি না মইরা গেছি, কেউ কোনো খবর নেয় নাই। মহররম আইলেই টেলিভিশন আর পেপারের সাংবাদিকরা আহে। এ ছাড়া কেউ কোনো খবর নেয় না। আমরা কত কষ্টে আছি, এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আপনে গো লেহন লাগবো না। 

এা মাজেদা বেগম লোক মুখে শুনেছেন, ওইদিন জামিল হোসেন হোসেনী দালানের মুল ফটকের একটু ভিতরে দাঁড়িয়ে তিলের খাজা বিক্রি করছিলেন। ওই সময় আকস্মিক বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে তিনি মারা যান।  বোমা হামলার ঘটনায় জামিল ও সাজ্জাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা না হলেও পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে। ওই মামলার  রায়ে আরমানের ১০ বছর ও কবির হোসেনের ৭ বছর কারাদ- দিয়েছেন আদালত। আর বাকি ৬ আসামিকে খালাস দেন। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে গত ১ মার্চ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন বিচারক।

২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালান এলাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এ ঘটনায় রাজধানীর চকবাজার থানায় এসআই জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে চকবাজার থানা পুলিশ। পরে এর তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। এই হামলায় জড়িত ১৩ জঙ্গির মধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযানের সময় তিন জঙ্গি ক্রসফায়ারে মারা যান। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা সবাই জেএমবির সদস্য।

২০১৭ সালের ৩১ মে ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর পর ওই আদালতে মামলার বাদী মো. জালাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেন। এরপর ২০১৮ সালের ১৪ মে মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়। তারপর ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

এই মামলার আসামিরা হলেন- কবির হোসেন, রুবেল ইসলাম, আবু সাঈদ, আরমান, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাসুদ, শাহ জালাল, ওমর ফারুক, চাঁন মিয়া, জাহিদ হাসান ও মাসুদ রানা। আসামিদের মধ্যে আরমান, রুবেল ও কবির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলার নথি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত আবদুল্লাহ বাকি ওরফে নোমান ছিলেন হোসেনি দালানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। হামলার আগে ১০ অক্টোবর তারা বৈঠক করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। বোমা হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন জাহিদ, আরমান ও কবির। কবির ও জাহিদ ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন। হামলার পর আশ্রয়ের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া করেন আরমান ও রুবেল। ঘটনাস্থলে আরমান পরপর পাঁচটি বোমা ছুঁড়েন।

বাকি পাঁচজন চান মিয়া, ওমর ফারুক, আহসানউল্লাহ, শাহজালাল ও আবু সাঈদ হামলার ভিডিও করা ছাড়াও হামলায় উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেন। আসামি মাসুদ রানারও হামলায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন ঢাকার গাবতলিতে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে এএসআই ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে গ্রেপ্তার হন তিনি।

এমটিআই

Wordbridge School

সোনালী বিশেষ বিভাগের আরো খবর

Link copied!