• ঢাকা
  • বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১

বিরোধীদের ঐক্যের বার্তা জানানোর কৌশল


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৮, ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
বিরোধীদের ঐক্যের বার্তা জানানোর কৌশল

ঢাকা : হঠাৎ বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্য’র আহ্বান নিয়ে নানা মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে দেশের চলমান পরিস্থিতিকে ক্রান্তিকাল হিসাবে দেখছে বিএনপি। এজন্য এখনই জাতীয় ঐক্য গঠনের উপযুক্ত সময় হিসাবে মনে করছে দলটি। সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছেন তারা।

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ৩৯ দল ছাড়াও ইসলামী, বাম ও ডানপন্থি আরও ১৫টি দলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রথমে সব দল মিলে একটি যৌথ বিবৃতি দিতে পারে। পরে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার কথা ভাবছে বিএনপি। তবে এই ঐক্যের আহ্বান নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে কয়েকটি দলের।

বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যের বিষয়ে বামপন্থি কয়েকটি দল আরও সময় নিতে চাইছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে এসব তথ্য।

বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্য হয়েই আছে। বৃহত্তর পরিসরে এ ঐক্য গঠনে আগে থেকেই কাজ চলছে। এরমধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও উদ্ভূত পরিস্থিতি ঐক্য গঠনের সঠিক সময় হিসাবে মনে হয়েছে।

এর কারণ হিসাবে নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে এবং তারা মাঠেও ছিলেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে।

নেতারা মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী নামানোর অর্থ হচ্ছে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন আবার বিরোধীদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশের সরকারই সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। দেশের স্বার্থে এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু সরকার তা না করে বিরোধীদের ধরপাকড়সহ নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে।

এই ক্রান্তিকালে সরকার যেহেতু জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবছে না, তাই বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির দায়িত্ব থেকে ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে।

নেতারা আশা করছেন, দেশের স্বার্থে এই আহ্বানে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল সাড়া দেবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বর্তমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা। দেশকে রক্ষার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। এজন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়েছে। আর একদফা দাবিতে জাতীয় ঐক্য তো হয়েই আছে। এখন ঐক্য নিয়ে কাজ করার ব্যাপার। এখানে বিএনপির দলীয় কোনো স্বার্থ নেই।

দেশকে বাঁচানো ও জনগণকে রক্ষার স্বার্থে কাউকে না কাউকে ঐক্যের ডাক দিতে হবে, জনগণের দল হিসাবে বিএনপি সেই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। আশা করি বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে জবাবদিহির সরকার প্রতিষ্ঠা করবে।’

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে সমর্থন ও সাধুবাদ জানিয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির-এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ শনিবার (২৭ জুলাই) এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনরত দলগুলোর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

দুর্নীতিবাজ ও জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিএনপির পক্ষ থেকে যে ঐক্যের ডাক দেয়া হয়েছে, সেই পদক্ষেপকে এলডিপি সমর্থন করছে এবং সাধুবাদ জানাচ্ছে। এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল থাকবে এলডিপি।’

শুক্রবার (২৬ জুলাই) রাতে এক বিবৃতিতে সব রাজনৈতিক দল নিয়ে একদফা দাবি আদায়ে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানায় বিএনপি।

এতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিক দল ও জোট, বাম-ডান সব রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক ও সব ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ন্যূনতম একদফা, অবৈধ, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যের এই আহ্বান।’

বিবৃতিতে জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে, লুণ্ঠিত গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, অধিকারহীন জনগণের ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম একদফা দাবিতে দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের চার দল, ১২ দলীয় জোটের ১২ দল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১ দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যৈর চারটি দল, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, গণফোরাম, পিপলস পার্টি, লেবার পার্টিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৯ রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্যে থাকবে। এর বাইরে জামায়াতে ইসলামীও ঐক্যে থাকছে। তবে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চে থাকা দুটি দল আরও সময় নিতে চাইছে।

এছাড়া চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন, ববি হাজ্জাজের এনডিএমসহ আরও ১৫টি রাজনৈতিক দলকেও পাশে চাইছে বিএনপি। এর মধ্যে ইসলামী, বাম ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দল রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে। তারপরও শনিবার বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে ভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলগুলো বাদে বিরোধী সব দলের সঙ্গেই বিএনপি আলোচনা করবে। যৌথ বিবৃতি আসতে পারে। কর্মসূচি নিয়েও চিন্তা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দেড় শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, এখনও চলছে নির্যাতন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে, সেখানে ছাত্র পেলেই তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপি নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের নাশকতার সঙ্গে নয়, সিসিটিভি ফুটেজসহ কোনো কিছুতেই প্রমাণ দেখাতে পারবে না।

অথচ বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর দোষ চাপিয়ে গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা সভ্য সমাজে হতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পদত্যাগই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অনেক বিরোধী দল তো যুগপৎ ধারায় একটা আন্দোলনে আছি। এর বাইরেও অনেক দল রাজপথে আছে। যারা যুগপতে আছেন এবং যারা বাইরে আছেন যার যার জায়গা থেকে আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।

আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে আরও সংহতি, আরও বোঝাপড়া বাড়বে। সেটাই আমরা হয়তো দেখতে চাইব।’

শনিবার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছে চরমানোই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে দেখেছি। এ বিষয়ে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পরে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, জাতীয় ঐক্য গঠনের বিষয়ে মূলত যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দল ও একই দাবিতে আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট আলাদাভাবে আন্দোলন করবে বলে জেনেছি। তবে তাদের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ থাকবে।

বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্যে’র আহ্বান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট আওয়ামী বিরোধী এবং জামায়াত-জাতীয় পার্টি ও এই বলয়ের বাইরের ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম জোট।

জাসদ, ঐক্য ন্যাপসহ বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে বিকল্প গড়ে তুলে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে এবং দুঃশাসনের অবসান ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা তাদের অবস্থানে থেকেই আন্দোলন করবে।

সুতরাং বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়।’

এমটিআই

Wordbridge School

সোনালী বিশেষ বিভাগের আরো খবর

Link copied!