গাজীপুর: দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রাণকেন্দ্র ও সর্ব বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গাজীপুর ও সাভার। তবে গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন দাবিতে এই দুই পোশাক শিল্পাঞ্চলে চলছে শ্রমিক বিক্ষোভ। শ্রমিকদের এ বিক্ষোভ প্রথমে শান্তিপূর্ণ হলেও, পরবর্তীতে সেটি সহিংস আন্দোলনে রূপধারণ করে। পরে এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
এ দিকে এই দুই শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক নেতারা বলছেন অন্যকথা। তারা বলছেন, এই মূহুর্তে পোশাক শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধি বা বড় ধরনের কোন চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কোন আন্দোলন করছে না। কোথাও- কোথাও অভ্যন্তরীন দুই একটা গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ দেখালেও পরে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে সমাধান হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা পোশাক কারখানায় আন্দোলন করছে তাদের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক থেকে বহিরাগত দুষ্কৃতকারী বেশী।
বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান জানান, গাজীপুর ও সাভার শিল্পাঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকটি পোশাক কারখানায় বকেয়া বেতন, ছুটি, শ্রমিক ছাঁটাই, হাজিরা বোনাস, টিফিন ভাতা ও নারী শ্রমিকদের পাশাপাশি সমতার ভিত্তিতে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষই সমাধান করেছেন।
তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পাঞ্চলে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী মহল ও ব্যক্তি বিশেষ কিছু কারখানার অভ্যন্তরীন বিষয়ে শ্রমিক অসন্তোষকে পুঁজি করে বহিরাগত দুষ্কৃতকারী শ্রমিকদেরকে ভাড়া করে কারখানায় হামলা ও ভাংচুরের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। আসলে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই সুযোগে রাজনৈতিক প্রভাব ও কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা।
দেশের অর্থনীতি চাকা সচল রাখার এই শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক অসন্তোষের মূল কারন খুঁজতে গিয়ে এমন তথ্যই পেয়েছে সোনালী নিউজ। অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের দুই শিল্পাঞ্চলে পোশাক শিল্প কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ বা অস্থিরতার মূলে রয়েছে এলাকা ভিত্তিক বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে পোশাক শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলেছেন তারা।
বিগত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের ভোগরা বাইপাস, ছয়দানা, হাজির পুকুর, মালেকের বাড়ি, সাইনবোর্ড এলাকায় বিক্ষোভ করে পোশাক শ্রমিকরা। এসব এলাকায় আন্দোলনকারী শ্রমিকদের মধ্যে সুইং অপারেটর সোহেল মিয়া বলেন, তারা মূলত একটা বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিক্ষোভ করছেন। সেটি হলো নারী শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিকদেরও সমহারে নিয়োগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, গার্মেন্টস কারখানার গেটে গেলে পুরুষ শ্রমিক নিতেই চায়না। আমরা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। তবে পোশাক কারখানায় হামলা ও ভাংচুর চালিয়েছে বহিরাগত লোকজন। তারা স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভাড়াটে লোকজন এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
এই বিষয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত এসপি ইমরান হোসেন সোনালী নিউজকে বলেন, ‘গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের কিছু এলাকায় বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। তবে পোশাক কারখানায় ভাংচুর ও হামলা চালানোর পেছনে বহিরাগত শ্রমিকরা জড়িত ছিল।’ তিনি আরও জানান, শ্রমিক আন্দোলনের সুযোগে রাজনৈতিক দলের ঝুট ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছেন বলে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আশুলিয়া শিল্প অঞ্চলের নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, পল্লী বিদ্যুৎ জামগড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা গত কয়েক দিন ধরে ১১দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, যেনো কথায়-কথায় মালিক কর্তৃপক্ষ তাঁদের যেন চাকুরিচ্যুত করা না করেন, শ্রমিকদের অন্তত ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা, হাজিরা বোনাস ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা করতে হবে; প্রমোশনের ক্ষেত্রে চাকরির বয়স কমপক্ষে ৩ বছর ও যোগ্যতা অনুসারে হতে হবে। এসব নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পরে শ্রমিকদের আন্দোলন সহিংস রূপধারণ করলে ৩০/৪০টি পোশাক কারখানার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে।
এ শিল্পাঞ্চলে পোশাক শ্রমিক সুমি আক্তার বলেন, কে ক্ষমতায় আসলো কে ক্ষমতায় গেল এগুলো নিয়ে পোশাক শ্রমিকরা সাধারণত কখনো ভাবেন না।তারা শুধু তাদের নিজেদের উপর অন্যায় ও জুলুম হলে ওইসব দাবিতে আন্দোলন করেন। এর মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। আমরা নারী শ্রমিকদের কারখানায় নিয়োগের সুযোগ থাকলেও পুরুষ শ্রমিকরা নিয়োগ না পাওয়ায় দিন- দিন বেকার হয়ে পড়ছে পুরুষ শ্রমিকরা। তারা বেকার হলে সংসার চালাবে কে? এজন্য তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ করেছি। কিন্তু আমরা কোন ভাংচুর করি নাই।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম সোনালী নিউজকে বলেন, ‘আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে পোশাক শ্রমিকরা যেসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন করেছে, তার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর অভ্যন্তরীন বিষয়ই বেশি ছিলো। এ আন্দোলনগুলো মূলত সেন্টাল শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। আর আন্দোলনে কারখানা ভাংচুরের পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের ঝুট ব্যবসার মূলহোতাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে বহিরাগত লোকজন ভাড়া করে কারখানায় ভাংচুর চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।’
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক দিন ধরে কারখানা বন্ধ রাখা হলেও যৌথ বাহিনীর সক্রিয় অবস্থানে সব কারখানাগুলো এখন খোলা হয়েছে।
এদিকে দেশের প্রধান দুই পোশাক শিল্প এলাকায় হঠাৎ করেই শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় বিপাকে পড়েছে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বিজিএমইএর সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি পোশাক শিল্প এলাকায় কোন না কোন কারখানায় বিভিন্ন দাবি বা চাওয়া-পাওয়া নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ থাকে। তবে এটা হলো সংশ্লিষ্ট কারখানার অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আবার এসব সমস্যাগুলো অভ্যন্তরীণ ভাবেই সমাধান করা হয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে পোশাক গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভার শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে। এটার মূলে রয়েছে তৃতীয় পক্ষের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য। কেননা শ্রমিক আন্দোলনের সুযোগে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো যায়। আমরা আশাবাদী বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ভাবমূর্তি যাতে নষ্ট না হয় এবং তৈরি পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে না যায়।
এজন্য তিনি শিল্প উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, শ্রমিকদের আড়ালে পোশাক শিল্প অস্থিতিশীল করতে কেউ কলকাঠি নাড়ালে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এসএস