ঢাকা : গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এসব মামলায় অনেক হেভিওয়েট নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এতে ব্যাপক রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ।
জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিগগিরই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোকে আইনিভাবে মোকাবিলা করাই এখন তাদের লক্ষ্য। সময় হলেই নেতাকর্মীরা আইনজীবী নিয়োগ দেবেন। প্রয়োজন হলে বিদেশি আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া হবে।
তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, মামলা লড়াইয়ের জন্য এখনও উপযুক্ত সময় আসেনি। সময় হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দলীয় সূত্র মতে, ক্ষমতা হারানোর পর থেকে মামলা আর হামলার ভয়ে দিন পার করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। যখন-তখন বাড়িঘরে হামলার শঙ্কায় দিনাতিপাত করছেন তারা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে অবস্থান করতে পারছেন না। কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন, কেউ কেউ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
যারা বাড়িতে থাকছেন, রাত হলেই তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। হামলা থেকে বাঁচলেও রেহাই মিলছে না মামলা থেকে। এরই মধ্যে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নামে দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে। বাদ পড়েননি শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামও।
দলীয় সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৮২টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬২টিই হত্যা মামলা। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১৩টি ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে ১০টিসহ মোট ২৩টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করেছেন।
মামলাগুলোতে শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ নানা পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা ও শীর্ষপর্যায়ের নেতা মিলিয়ে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আসামিদের তালিকায় সাবেক দুই আইজিপিসহ ৮৮ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় ২৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলা, জেলা, মহানগর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগের নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ মামলাই হত্যা সংক্রান্ত। কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকে আত্মগোপনে চলে গেলেও বিপদে পড়েছেন তৃণমূলের নেতারা।
এদিকে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হামলার শিকার হয়েছেন এবং যাদের বাসাবাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে, তারা যেন নিজ নিজ থানায় অভিযোগ বা সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন।
কারণ হিসেবে সেখানে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুসন্ধান দল এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তারা গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ধরনের সহিংস ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করবেন। দলের পক্ষ থেকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে বলা হয়েছে।
‘অভিযোগ না নিতে চাইলে সাধারণ ডায়েরি করুন, যদি সাধারণ ডায়েরি করতে না দেয় তাহলে জাতিসংঘের তদন্ত দলের কাছে দলীয়ভাবে আমরা অভিযোগ দেব’— বলা হয় ওই নির্দেশনায়।
আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, সময় হলে অবশ্যই আমরা আইনিভাবে মামলাগুলো মোকাবিলা করব। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নয়, আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। পুলিশ এখনও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। সময় মতো আমরা আইনি লড়াইয়ে নামব। আমাদের প্রস্তুতি চলছে।
মামলা লড়তে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে কি না— জবাবে তিনি বলেন, প্রয়োজন পড়লে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে। পরিস্থিতি ও সময় সেটি বলে দেবে।
এদিকে, রাজধানীসহ সারাদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আগামী দুই মাস (৬০ দিন) এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।’
প্রজ্ঞাপন জারির পরই নিজেদের ওপর হামলার ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা সারাদেশ থেকে খবর পেয়েছি যে বেশিরভাগ থানাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে দেওয়া হয়নি। যেহেতু সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে, তাই অপরাধীদের থামাতে এখন সেনাবাহিনীর কাছেই অভিযোগ দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘ক্ষতিগ্রস্ত সবাই পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে গিয়ে সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ জমা দিন। সেনাবাহিনীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যে, সব অপরাধী, সন্ত্রাসী ও লুটেরাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
এমটিআই