ঢাকা : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে গেছে দেশের রাজনৈতিক পট। নতুন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের মতো করে নতুন মেরুকরণের রাজনীতিতে হিসাব-নিকাষ কষছেন। এই আবহে দীর্ঘদিনের মিত্র এখন দাঁড়িয়ে গেছে মুখোমুখি অবস্থানে।
এমনটাই ঘটেছে দীর্ঘদিনের ভোটের মাঠের মিত্র জামায়াত ইসলামি ও বিএনপির মধ্যে। আগেই ঘোষণা ছিল, তুরা আর কোনো জোটে নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন উদ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা দলটি এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে পৃথক জোট গঠনের। এ লক্ষ্যে সমমনা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় শুরু করেছেন জামায়াতের নেতারা।
অপরদিকে বিএনপিও চাইছে জোটবদ্ধ নির্বাচন থেকে বের হয়ে একক নির্বাচন করতে। কারণ হিসেবে দলটির একাধিক শীর্ষনেতা জানিয়েছেন, নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপির সরকার গঠন এখন মাত্র সময়ের ব্যপার। নির্বঅচন হলে একক দল হিসেবে বিএনপি বিপুল সংগরিষ্ঠতা পাবে।
জামায়াতের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা খুবই কম। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আলাদা জোট করে নির্বাচন করা যায় কি না, সেই পরিকল্পনা করছে দলটি। এ জন্য তারা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
এ লক্ষ্যে গত ১৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াত। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিসের দুই অংশ ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে পৃথক মতবিনিময় করেন জামায়াতের আমির।
জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, মতের ভিন্নতা থাকলেও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য চায় জামায়াত। দলগুলোও এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে সম্পর্ক উন্নয়নে। সেখানে অন্য আলোচনার মধ্যে নির্বাচনের আলোচনাও আসছে। নির্বাচন করলে সবার সহযোগিতায় করা উচিত বলে মনে করছে সবাই। এ বিষয়ে সবাই গুরুত্বও দিচ্ছে। যদিও আলোচনার মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ রয়েছে, চূড়ান্ত কোনো কিছু এখনো হয়নি।
১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াতে ইসলামী। ওই দুই নির্বাচনে যথাক্রমে ১২ দশমিক ১ এবং ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পায় দলটি। ২০০১ এবং ২০০৮ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে জামায়াত। এরপর নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৮ সালে বিএনপির প্রতীকে জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে নানা কারণে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। গত ২৯ আগস্ট গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সঙ্গে জোট বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এটা এখন কোনো কাজ করে না।’ পরদিনই এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই।
বিএনপির সঙ্গে এই মুহূর্তের সম্পর্ক কেমন জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কথা আমরা বলি না। আবার সম্পর্ক গভীর, এটাও বলা যাবে না। আনুষ্ঠানিক বৈঠক না হলেও আমরা বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা গত ১৫ বছর যে দলটির কাছে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তারা এখন মাঠে নেই। সে কারণে খুব সহজেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন নেতা-কর্মীরা। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে চান জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা। আগামী নির্বাচনেও এর প্রতিফলন দেখতে চান তারা। এ লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘এককভাবে বলছি না, জোটগতভাবেও বলছি না। কী করব, পরিস্থিতি বলে দেবে। যদি জোট করা লাগে, পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে জোট হবে। তবে এ সময় কিছু বলতে চাই না।’
এমটিআই