ঢাকা : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সবশেষ গত শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়েছে। তৃতীয় দফার এই সংলাপেও নির্বাচন প্রশ্নে দেশের অন্যতম প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিভক্তি ফুটে উঠেছে। সংলাপে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ছাত্র—জনতার গণ—অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কাজকর্ম ও নির্বাচন প্রশ্নে দুই ধরনের অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে দল দুটির মধ্যে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে একই সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপও দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকতে হবে, তা না হলে রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়বে, জনগণ হতাশ হয়ে যেতে পারে।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিএনপি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছিল, যদিও দ্রুতই দলটি সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। তারা নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে অবস্থান স্পষ্ট করে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কয়েকটি দল শুরু থেকে সংস্কার কাজের ওপর গুরুত্ব দিতে থাকে। মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। জামায়াত ইসলামি দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে বিএনপি বিভিন্ন ভয় পাচ্ছে, এমনকি দলটির সিনিয়র নেতারা বারবার মাইনাস টু ফর্মুলাকে স্মরণ করিয়ে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে দলটির নেতাদের বাদানুবাদে জড়াতে দেখা গেছে, যা রাজনীতিতে অস্থিরতা ছড়াতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যারা মনে করবে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় আসবে, তারা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাবে এবং যারা মনে করবে, নির্বাচন হলে তাদের সরকার গঠনের সম্ভাবনা কম, তারা নির্বাচন দেরিতে হোক এমনটাই চাইবে। উভয়টাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হবে জনগণ কী চায়, যেটা এখনো স্পষ্ট নয়।
বর্তমানে বড় দুটি দলের মধ্যে নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে যে দূরত্ব, তা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এতে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে পারে এবং জনগণও বিভক্ত হয়ে যেতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, সরকার তো ইতিমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, এখন যদি নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়া যায়, তাহলে ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে সংস্কার করতে যতটা সময় সরকার প্রয়োজন বলে মনে করছে, সেটা হাতে নিয়েই এই রোডম্যাপ দিতে পারে। তাহলে কিন্তু খারাপ হয় না, এতে রাজনীতি শান্ত থাকবে। পাশাপাশি সরকারের সংস্কার কার্যক্রম কিন্তু স্পষ্ট নয়।
তারা কী কী সংস্কার করবে, কতটা করবে—এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া উচিত। তাহলে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
দেখুন সরকার যে কমিশন গঠন করেছে, সেখানে সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দলের কেউ নেই, যারা আছেন, তারা রাজনীতির বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। যে সংস্কারই করা হোক, তা কিন্তু সংসদে পাস করে অনুমোদন নিতে হবে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকতে হবে আর সেটা রাখতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
গত শনিবার সংলাপের প্রথম দিনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ হয়। সংলাপে বিএনপির প্রধান দাবি ছিল, নির্বাচন কবে হবে তার একটি রোডম্যাপ। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘সংস্কারকে এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সংস্কারের সময় কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে।’
বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল গণতন্ত্র মঞ্চে।
এই জোটের নেতাদের দাবি ছিল, সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও সম্পৃক্ত করা।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছে, সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনার পর নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হবে।
এই দুটি দল ও একটি জোটের দাবির দিকে তাকালেই তাদের রাজনৈতিক বিভক্তির প্রমাণ মেলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামিক দলগুলোর দিক থেকে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগে তারা যত সময় পাবে, সেটা আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে।
আর বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন আর সরকার গঠন এটুকু দূরত্বে তারা দাঁড়িয়ে আছে। সরকার চাইবে যত বেশি সময় নেওয়া যায়। তারা যে সংস্কার চাইছে, তার তো কোনো সীমা—পরিসীমা নেই। ইতিমধ্যে দেশের কিছু কিছু জায়গায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
জানিপপ চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচন—সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে রোডম্যাপ দিয়ে কাজ শুরু করা, পাশাপাশি সংস্কারকাজ চলবে। রোডম্যাপ দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, কালকেই নির্বাচন হয়ে যাবে। একটা গ্রহণযোগ্য সময় থাকবে।
ফলে সে সময় এবং পরিকল্পনা দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খোলাসা করতে হবে। তা না হলে বিভিন্ন অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য ইতিবাচক হবে না। মাথায় রাখতে হবে, সরকার যত বেশি সময় নেবে, তত জনপ্রিয়তা হারাবে।
এমটিআই