ঢাকা: আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বেগম মতিয়া চৌধুরী মারা গেছেন।(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন।
বাংলাদেশি নারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রভাবশালী এক নাম মতিয়া চৌধুরী। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে বলা হয় ‘অগ্নিকন্যা’। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তার যে উদ্দীপ্ত ভাষণ, সেই উদ্দীপ্ত ভাষণ তাকে অগ্নিকন্যার খ্যাতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।
মতিয়া চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী।
তিনি ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে রোকেয়া হলের ভিপি এবং ১৯৬৪ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তার নামেই ছাত্র ইউনিয়নে একটি গ্রুপের নাম হয়েছিল ‘মতিয়া গ্রুপ’।
এসময় বঙ্গবন্ধুর শরীরের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন বলে বক্তব্য দিয়েছে মতিয়া চৌধুরী, এমন কথা শোনা যায়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী একাধিকবার এমন কথা বলেছেন। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময় মতিয়া চৌধুরীর তখনকার একটি ছবি শেয়ার করে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করা হয়। তবে কোথায় এবং কেন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন তার কোনো দলিল/প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি।
আবদুল্লাহ হারুন জুয়েল তার একটি লেখায় বলেছেন, মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং ডাকসুর ভিপি ছিলেন ১৯৬৪ সালে। তিনি ছয় দফার পক্ষে ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন করে অগ্নিকন্যা খেতাব পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ন্যাপ-এ যোগদান করেন। চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে ছিলেন ভাসানী; মস্কোপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, যিনি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ও মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা হন। মস্কোপন্থী ন্যাপ কখনোই বঙ্গবন্ধু বিরোধী ছিল না। তাহলে মতিয়া চৌধুরী বিরোধিতা করবেন কোন প্রেক্ষাপটে?
মতিয়া চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিবি) যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির অঘোষিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মতিয়া চৌধুরী যে সম্মেলনে সিপিবির কেন্দ্রীয় সদস্য হন, সে সম্মেলনসহ ইউনিয়ন ও সিপিবির সব কাউন্সিলে প্রধান অতিথি রাখা হতো বঙ্গবন্ধুকে। সিপিবি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবেও অংশীদার হয়েছিল এবং মতিয়া চৌধুরী বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি কবে, কোথায় এবং কেন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন তার সদুত্তর কেউ দিতে পারবে না। এছাড়া মতিয়া চৌধুরীর স্বামী বজলুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে অনেকে দলত্যাগ করেছিল। কিন্তু মতিয়া চৌধুরীরা দুঃসময়ে দলে যোগদান করেছিলেন।
১৯৬৭ সালে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত মতিয়া পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং এর কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, তদবির এবং আহতদের শুশ্রুষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে মতিয়া যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়কালে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক এই জীবনে নানা দুর্বিষহ স্মৃতিও রয়েছে। দু-একবার নয়, জেলে গেছেন ১৫ বার। বছরের পর বছর কাটাতে হয়েছে জেলে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ টানা দুই বছর জেল খাটেন।
১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন।
নিজের রাজনৈতিক দক্ষতা-যোগ্যতায় তিন দফায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে তিনি কৃষি, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এ নিয়ে আরো দুই দফায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে শেরপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এর আগেও তিনি দুইবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আইএ
আপনার মতামত লিখুন :