ঢাকা : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে বিগত সরকারের আইন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সে আইনেই সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের পথে হাঁটল সরকার। সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতে যে সার্চ কমিটি করা হবে, তারা আগের মতো পক্ষপাতিত্ব করবে কি না?
অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করছেন, যেহেতু এবারে সার্চ কমিটি কোনো দলীয় সরকারে অধীনে হচ্ছে না, ফলে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে।
দেশে ২০১২ সালে সার্চ কমিটির প্রথা চালু হলেও আইন হয় ২০২২ সালে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে আইনটি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সার্চ কমিটির সুপারিশে আউয়াল কমিশন গঠিত হয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডামি নির্বাচন করার অভিযোগ রয়েছে। এর আগেও সার্চ কমিটির মাধ্যমে দুটো কমিশন গঠিত হয়েছিল। সে দুই কমিশনের করা নির্বাচনগুলোও ছিল বিতর্কিত। ওই সময় বিএনপিসহ বিরোধী সব রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটির বিরোধিতা করেছিল। এমনকি সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি সংলাপ ডাকলে তাতে সাড়া দেয়নি তখনকার বিরোধী দলগুলো।
বিদ্যমান আইন নিয়ে এমন বিতর্কের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করার কথা জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এর আগে গত ১৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে শিগগিরই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচনী যাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠন হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সই হওয়ার পর আজ বুধবারের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করতে রাষ্ট্র ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবে, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক।
সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এ দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন হবেন নারী। এ কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সার্চ কমিটি প্রথম বৈঠকেই কার্যপদ্ধতি ঠিক করে নিতে পারে। সুপারিশ চূড়ান্ত করতে কমিটিকে একাধিক বৈঠক করতে হতে পারে। কাজের সুবিধার্থে সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারের নাম চাইতে পারে।
সার্চ কমিটির সুপারিশ করা ১০ জনের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী সংলাপ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস, আইন সংস্কার ও নতুন দলের নিবন্ধনের কাজ শুরু করবে।
সার্চ কমিটির চ্যালেঞ্জ : এবার সার্চ কমিটি কোনো দলীয় সরকারে অধীনে না হলেও আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আড়ালে চলে যাওয়ায় নতুন কমিটি নিয়েও সেই পুরনো বিতর্ক আবার উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেমন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মতামত ছাড়াই কমিটি গঠিত হয়েছিল, এবারও তেমনি হতে পারে। আর এতে করে ওই সময় সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল, এবারও সেই একই বিতর্কের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। কোনো দলকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনীতির বাইরেও রাখা যাবে না। কারা এ প্রক্রিয়ায় থাকবে সে সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণই। সরকার এখানে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে গেলেই সেই পুরনো পরিস্থিতি ফিরে আসবে।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘যারা হাজার মানুষ হত্যা করেছে, ৪০-৫০ হাজার মানুষকে অঙ্গহানি করেছে। এখনো তাদের নেত্রী দেশের বাইরে বসে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কথা বলেন, অন্য দেশে বসে ২৮৭ জনকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। তিনি একজন গণহত্যা মামলার আসামি। তাদের বিচারের আগে নির্বাচনে আসা মানুষ মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা বিবেচনা করে দেখেন, এমন গণহত্যা চালানোর পরও তিনি দেখে নেওয়ার কথা বলেন, আমাদের নেতাদের কিশোর গ্যাং বলেন এই দলের রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত কি না, তা দেশের মানুষ বিবেচনা করবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার বলেন, ‘যদি গণতান্ত্রিক মানসিকতার হন, সে ক্ষেত্রে জনগণের ওপর আস্থা থাকতে হবে। কোনো দল যদি খারাপ কাজ করে সে বিবেচনাটাও জনগণ করবে। একটা প্রবণতা দেখছি, আওয়ামী শক্তি বা তাদের মিত্ররা যাতে নামতে না পারে, সেজন্য সরকারের একটা অংশ বা বিভিন্ন মহল সেই চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘মহা দুর্নীতিবাজ যারা, যারা দলকে ফ্যাসিস্ট হতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, তারা কিন্তু নেই। তারা সব পালিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও যারা কম দুর্নীতিবাজ, এ টাইপের লোকগুলোও কিন্তু ছাড় পাচ্ছে না। তার মানে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করার ওই রকম আগ্রহ তাদের নেই। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
দিলীপ কুমার বলেন, ‘যারা দুর্নীতিবাজ, অপকর্ম করেছে তাদের ধরা হোক, তাদের বিচার করা হোক। কিন্তু দলের মধ্যে যারা একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল, এই নেতৃত্বের দায় পুরো দলের ওপর চাপানো ঠিক হবে না।’
নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সার্চ কমিটি হয় সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের রাখার বিষয়ে তাদের প্রস্তাব ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু সে সুযোগ নেই, তাই সরকার আগের আইনেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সিস্টেম পরিবর্তন করতে গেলে সংসদ প্রয়োজন, সেটা তো নেই। নির্বাচন সংস্কার কমিশন কাজ করছে। তারা নির্বাচন কমিশনের সংস্কার নিয়ে আগামী ডিসেম্বরে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। তখন হয়তো সর্বজন গৃহীত নতুন নিয়ম আসবে। তখন এ সংকটগুলো কেটে যাবে।’
কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো : বিদ্যমান আইন নিয়ে দ্বিমত থাকলেও অন্তর্র্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চান গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি নিয়ে আমাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। আমরা বলেছিলাম, সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকা উচিত। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সে সুযোগ নেই। তবে আমরা আশাবাদী, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন গঠন করা হবে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে করুক। তারপরও সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একধাপ এগিয়ে গেল।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমদ বলেন, ‘সার্চ কমিটি করার বিষয়ে সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে কি না, জানি না। আমাদের বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে অন্ধকারে রেখে তড়িঘড়ি করলে বিপদের সম্ভাবনা বেশি হবে।’
কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে যেন বৈষম্য না হয় সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই কমিশন গঠন করতে হবে।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই