বরগুনা: নভেম্বর মাসের কথা শুনেলে আতঙ্কে থমকে যায় উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষের জনজীবন। নভেম্বর মাসের এক রাতে সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হেনেছিল উপকূলে। এই রাতে হাজারো পরিবার হারিয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজন। এখনো নিখোঁজ রয়েছে উপকূলের শত শত মানুষ, স্বজনরা ফিরে পায়নি তাদের পরিবারের সদস্যদের মরদেহের শেষ চিহ্নও।তাই নভেম্বর মাসের কথা শুনলেই শোকের ছায়া নেমে আসে পরিবারগুলোতে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। ১৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলও সেই আতঙ্ক এখনো ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ। নভেম্বর মাসের শুরুতেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে ।নভেম্বরের এক রাতে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী পাথরঘাটা, বরগুনা, বেতাগী, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলা এই সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অনন্য জেলাগুলো হচ্ছে, ঝালকাঠি, বরিশাল ও ভোলা, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী সাইক্লোন সিডরের কারণে সারাদেশে তিন হাজার ৪৪৭ জন লোক মারা যায়। নিখোঁজ হয় এক হাজার তিন জন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ধ্বংস হয় নয় লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি, দুই লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এই সাইক্লোনে প্রায় দুই লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁসমুরগী মারা যায়।
সিডরে বরগুনা জেলায় মারা যায় এক হাজার ৩৪৫ জন। নিখোঁজ ছিলেন ১৫৬ জন। পাথরঘাটায় মাত্র ১৫ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে ৩৯৪ জন মানুষ মারা যায় । ঝড়ের তাণ্ডবে পুরো এলাকা হয়ে যায় লণ্ডভণ্ড। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৯১ জনের জেলে এখন রয়েছে নিখোঁজ।
সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললে তারা জানান, সিডরের পর দীর্ঘসময় অতিক্রম হলেও মজবুতভাবে সংস্কার হয়নি বিষখালী বলেশ্বর নদী তীরবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধ গুলি। পাশাপাশি এসব এলাকায় নির্মাণ হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। এখনো একের পর এক দুর্যোগের কথা শুনলেই আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করেন উপকূলবাসীরা।
পাথরঘাটার সোহাগ বলেন , আমার জন্মের পর থেকে এরকম আর কোন বন্যা দেখিনি। বন্যার পরের সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে দেখি পানিতে ভাসছে গবাদি পশুর সহ মানুষের লাশ। নভেম্বর মাসের কথা শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই দুর্বিসহ রাতের কথা।
পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামে সিডরের রাতে জন্ম নিয়েছিল একটি শিশু। এলাকাবাসীরা এই শিশুটির নাম রেখেছেন সিডর কন্যা। সিডর কন্যার মা জাকিয়া বেগম বলেন, সিডরের রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় যখন বাবার হাত থেকে আমি ছুটে যাই তখন বাঁচা-মরা নিয়ে আমার কোনো ভাবনাই ছিল না। একটাই চিন্তা ছিল পেটের বাচ্চাটার কি হবে। অনেক চিৎকার করেছি কিন্তু রাতে প্রচণ্ড বাতাসে কেউ শুনতে পায়নি। পরে আমার বাবা আমাকে খুঁজে পায়। যখন আমাকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় তখন পেটের ব্যথা আর সহ্য করতে পারছি না। তখন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মাসহ কয়েকজন প্রতিবেশী নারীর সহায়তায় মেয়ের জন্ম হয়। আমি সহ স্থানীয় অনেকেই তাদের আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছে। নভেম্বর মাসের কথা শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই ভয়াবহ রাতের কথা। ভয়ে শিহরিত হয়ে ওঠে সমস্ত শরীর।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার রোকনুজ্জামান খান বলেন, সিডর বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এই ঝড় কেড়ে নিয়েছে উপকূলের মানুষের সম্বল। কেড়ে নিয়েছে আপনজনদের। তাই এ ক্ষতি অপূরণীয়।তবু সরকারি ও সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলো সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করলে উপকূলবাসীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। একইসঙ্গে পরবর্তী ভয়াবহতার হাত থেকেও রক্ষা পাবে।
এসএস