• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

রাজশাহীর পবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই যেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে!


জনাব আলী, রাজশাহী নভেম্বর ৪, ২০২৪, ০৯:১৮ পিএম
রাজশাহীর পবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই যেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে!

রাজশাহী: সারাদেশে প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। মশার কামড় থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিচ্ছে নানা পরামর্শ। দেশবাসী যখন ডেঙ্গু’র প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া, ঠিক তখন তার উল্টো চিত্র রাজশাহীর পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এই হাসপাতালের দিনে এবং রাত্রে মশার উপদ্রবে অতিষ্ট রোগী ও তার স্বজনরা। অভিযোগ রয়েছে মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করার।
 
রোববার (৪ নভেম্বর) সকালে সরজমিনে পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, হাসপাতাল ভবনের উত্তর-পূর্ব দিকে ড্রেনের ভিতরের ময়লা পানিতে এডিস মশার লার্ভা প্রজনন করছে। হাসাপাতালের ময়লা পানির ড্রেন দীর্ঘদিন পরিষ্কার না হওয়ার ফলে সেখানেই মশার বংশ বিস্তার করতে দেখা যায়। এই বিষয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সাথে কথা বললে তারা হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক অভিযোগ করেন সোনালীনিউজের প্রতিবেদকের কাছে। তারা জানান, সন্ধ্যা হলেই মশার কামড়ে এখানে বসে থাকাই অনেক কষ্টকর হয়। মশার বিষয়ে হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্সদের জানালে তারা রোগীদের সিলিং ফ্যান ছাড়তে বলেন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের বিল নেপালপাড়া এলাকার শহিদুল ইসলাম এই বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ করে বলেন, ‌‌‌‌‘বিকেলের পর থেকেই মশার অত্যাচারে এখানে আমাদের রোগীদের টিকে থাকাই মুশকিল। আমরা এমনিতেই আছি বিপদে তার উপরে প্রতি রাতে মশার কামড়ে আমরা অত্যন্ত কষ্ট করছি। এখানে নার্সদের বললেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না, উল্টো তারা আমাদের ঝাড়ি মেরে কথা বলে। আসলে বাবা, আমরা হলাম অসহায়।’

নেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দূভোর্গে ভোগান্তি
নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রোগীর ওয়ার্ডের পাশে এবং টয়লেটে বাজে দুর্গন্ধে সেখানে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যায় রোগী ও তাদের সাথে স্বজনদের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় তারা নাকমুখ গুঁজে টয়লেটে প্রবেশ করছেন। পুরো শৌচাগার কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হওয়ায় তা ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকে পড়ছেন বেকায়দায়। 

রোববার সকালে সরেজমিনে ওই হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বর্জ্যে ভর্তি গামলাগুলো রোগীদের শয্যার পাশে পড়ে রয়েছে। রোগীদের অভিযোগ, আগে ময়লার গামলাগুলো নিয়মিত পরিস্কার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এগুলো বর্জ্যে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পর পর পরিস্কার করে, এতে করে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে হাসপাতাল জুড়ে। নারী ওয়ার্ডের একমাত্র শৌচাগারের দরজা কেউ খুললে উৎকট দূর্গন্ধে ভেতরে টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ভর্তি থাকা রোগী ও তাদের স্বজনরা অনেকে বমি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টয়লেটের ভেতরটা কর্দমাক্ত। একই অবস্থা মহিলা ওয়ার্ডের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত পুরুষ ওয়ার্ডেও।

মহিলা ওয়ার্ডের শৌচাগারের পাশে থাকা শয্যায় পেটের সমস্য নিয়ে ভর্তি ছিলেন দর্শনপাড়া ইউনিয়নের এক বৃদ্ধা নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বাপু আমি ভর্তি হউয়ার পরদিন থেইক্যা এখানে দূর্গন্ধে বাঁচতে পারি না। নার্স আপাদের বুললে তারা আমাহেরে কথা শুইনে না। এখন কষ্ট নিয়ে আছি বাপু, কি আর বুলবো। পরে দেখা যাবেনি আমার আবার কোন সমস্যা হবি।’

সময়মতো আসেন না বর্হিবিভাগের চিকিৎসক
৩১ শয্যার পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগে কনসালটেন্ট আছে ৪ জন। কিন্তু সেবা নিতে আসা রোগীরা অভিযোগ করে জানান, হাসপাতালে কনসালটেন্টরা নিয়মিত ও সময় মত হাসপাতালে আসেন না। এই বিষয়ের সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে উপস্থিত রয়েছেন মাত্র ২ জন কনসালটেন্ট। কনসালটেন্ট ২ ও ৩ নম্বর রুমে গিয়ে দেখা যায় সেই রুমে কেউ নেই। দায়িত্বরত অফিস সহায়কদের মাধ্যমে জানা যায়, তারা এখনো হাসপাতালে এসে উপস্থিত হননি। কেউ আবার আছেন মিটিং এ, আজকে আসতে পারবেন না। 

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নওহাটা পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের আরেফা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এই হাসাপাতাল আগে ভালোই তো চিকিৎসা দিতো আমাদের। কিন্তু ইদানিং ডাক্তার সাহেবদের হাসপাতালে নিয়মিত পাওয়াই যায় না। তারা যদি সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হয়ে চিকিৎসা দেয় তাহলে এই হাসাপাতালে রোগী আরও বাড়বে।’

মাজা ব্যাথা নিয়ে স্থানীয় সাহাপুর এলাকার ইসকান আলী আসেন হাসপাতালের বর্হিবিভাগে কনসালটেন্ট দেখাতে। ভালো ওষুধ এবং কনসালটেন্টের পরামর্শ না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে দেখা যায় তাকে। তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘৫ মিনিট বসে থাকলে আর উঠে দাঁড়াতে পারি না বাবা। এখানে এসেছি ভালো ডাক্তার দেখিয়ে এখান থেকে ভালো ওষুধ দিবে। কিন্তু আমাকে দিলো মাত্র কয়েকটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আর ভিটামিন ওষুধ। ডাক্তারদের কাছে থেকে একটু ভালো পরামর্শ নিবো, কিন্তু তাদের যে ব্যবহার তারা তো ভালো করে আমাদের সাথে কথাই বলে না। তাদের ব্যবহার খুবই খারাপ।’

এছাড়াও কয়েকজন চিকিৎসা সেবা গ্রহীতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কনসালটেন্টরা হাসপাতালে আসেন প্রায় সময় বেলা দশটার পরে এবং তারা দুপুর না হতেই আর চিকিৎসা সেবা দেন না। মাত্র দু-এক ঘণ্টার জন্য বসেন হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় কনসালটেন্টের হাতে মোবাইল ফোন এবং কানে হেডফোন দিয়ে রাখতে দেখা যায়।

উপরোক্ত সমস্যা ও রোগীদের অভিযোগের বিষয় নজরে আনা হলে পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রাবেয়া বসরী জানান, হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও কনসালটেন্ট এর স্বল্পতা রয়েছে। তিনি বলেন,‘আমাদের এই হাসাপাতাল অনেকে মনে করেন ১০০ শয্যার, কিন্তু আসলে আমাদের এই হাসপাতাল ৩১ শয্যার। এখানে রোগী ভর্তি থাকার কথা ৩১ টা, কিন্তু আসলে বাস্তব চিত্র হচ্ছে আমাদের এখানে বর্তমানে ভর্তি আছে ৮০-৯০ জন। আর রোগীর সাথে থাকে আরও ১৫০ জন। এত সংখ্যক রোগী ও তাদের স্বজনের চাপ সামাল দেওয়া আমাদের জন্য অনেক কঠিন। আমাদের এখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছে মাত্র ১ জন এবং আউটসোর্সিং এ আছে ১ জন। আমি আমার ব্যক্তিগত ভাবে তাদের দেখি।’
 
তিনি বলেন, ‘আর আপনারা যেই বিষয়ে অভিযোগ পাচ্ছেন যে কনসালটেন্টরা নিয়মিত ও সময়মতো আসে না, আসলে এটি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমার এখানে বায়োমেট্রিক্স আছে, সবাই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। কেউ যদি অনিয়মিত এবং সময়মতো না আসে তাহলে তার বেতন অটোমেটিক ঢাকা থেকে কর্তন হয়ে যাবে। আমাদের হাসাপাতালের রোগীদের সচেতন হওয়া দরকার। রোগী ও তাদের সাথে স্বজনদের ওয়াশরুশ ব্যবহার করা শিখতে হবে। আমি হাসপাতালে আনসার নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি। আনসার হলে অনেকে নিয়মগুলো মানবে। তবে আপনাদের কাছে যারা অভিযোগ বা অনিয়মের কথা বলছে সেগুলো বাস্তবে কোন ভিত্তি নেই।’

এসএস

Wordbridge School
Link copied!