• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
টাকার অভাবে বন্ধ চিকিৎসা

শরীরে ৭ গুলি নিয়ে কাতরাচ্ছেন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সুজন


জামাল উদ্দিন বাবলু, লক্ষ্মীপুর নভেম্বর ৬, ২০২৪, ০৭:৫৬ পিএম
শরীরে ৭ গুলি নিয়ে কাতরাচ্ছেন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সুজন

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন (১৮)। সেসময় তার শরীরে ১০টি ছোঁড়রা গুলি লাগে। এর মধ্যে একটি গুলি লাগার সাথে সাথেই বের হয়ে যায়, আর দুটি গুলি অস্ত্রোপচার করে বের করেন চিকিৎসকরা। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে এখনো ৭টি গুলি রয়েছে গেছে।  ফলে প্রায় দুই মাস হাসপাতালে থাকার পর বাড়িতে আসলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি সুজন। সে গায়ে গেঞ্জি, শার্ট, পাঞ্জাবি যেটাই পড়ে, সেটাই কেউ না কেউ পরিয়ে দিতে হয়। নিজেও একা উঠ-বস করতে পারেন না। নিজের হাতে খেতে পারেন না খাবার। তার মা তাকে ভাত খাইয়ে দেয়। চলতে পারে না কারও সাহায্য ছাড়া। 

এমতো অবস্থায় অর্থ সংকটে চিকিৎসাহীন হয়ে পড়েছেন সুজন। তার পরিবারের পক্ষে যেখানে দেশেই চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়, সেখানে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা হলেই সুজন পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের মানসিক ভারাসাম্যহীন শাহীন কাদির ও আমেনা বেগম দম্পতির মেঝো ছেলে সুজন। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সে।  তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ সুজন নিজের পড়ালেখা আর পরিবারের সদস্যদের খরচ জোগাতে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। অসুস্থ হওয়ার পর সেখানে কাজ করাও বন্ধ।  তার বড় ভাই সোহান হোসেন বাবার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন। আর ছোট ভাই শিহাব হোসেন পড়েন অষ্টম শ্রেণিতে।

খালেদ মাহমুদ সুজন সোনালীনিউজকে জানান, শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের সকল কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ৪ আগস্ট দুপুরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে তার শরীরে ১০টি বুলেট বিদ্ধ হয়। একটি সাথে সাথে বের হয়ে গেছে। আর অস্ত্রোপচার করে দুইটি গুলি বের করলেও ৭টি গুলি এখনো শরীরে রয়ে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তিনি।  তারপরও এখনও সরকারিভাবে কোন সহায়তা পাননি সুজন ও তার পরিবার। তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সকলের সহযোগিতা চান আন্দোলনের এই সম্মুখ যোদ্ধা।

সুজনের চাচা কফিল উদ্দিন সোনালীনিউজকে বলেন, ‘আমার ভাতিজা সুজন ছিলো তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। সুজন হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলেও, এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। অন্যের সাহায্য নিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, চলতে হয়। সুজন ও তার পরিবারের সামনের দিনগুলো এখন কীভাবে কাটবে তা নিয়ে চিন্তিত তারা। সরকার যদি তাদেরকে সাহায্য সহযোগীতা করে, তাহলে তার চিকিৎসা ও সংসার চলতে পারবে।

সুজনের চাচি নাহিদা জীবন নাহার বলেন, আমাদের চোখের সামনেই সুজন বড় হয়েছে। সে সুস্থ ছিলো, লেখাপড়া করতো। পাশাপাশি উপার্জন করে সংসার চালাতো।  গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন অসুস্থ। চলাফেরা করতে পারে না। সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন সরকার যেন তাকে সহযোগিতা করেন। তাহলে তার চিকিৎসা হবে। 

সুজনের ঘনিষ্ট বন্ধু মেহেরাজ হোসেন বলেন, সুজন আর আমি ছোট বেলা থেকে একসাথে চলাফেরা করতাম। খেলাধুলা করতাম। এখন সে গুলিবিদ্ধ হয়ে অসুস্থ অবস্থায় আছে। চলাফেরা করতে পারে না। এখন তার সাথে চলতে পারি না, খেলাধুলাও করতে পারি না। আমার খারাপ লাগে। তাকে দেখলেই আমার কষ্ট বেড়ে যায়। তার সাথে এখন কেউ নেই। এটা আমার খারাপ লাগে।

প্রতিবেশী প্রতিবেশি ফিরোজ আলম জানান, সুজন লেখাপড়া করতো, পাশাপাশি একটি দোকানে চাকরিও করত। সে চাকরির টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলত। এখন সে অসুস্থ হওয়ায় তার সংসার চলতে হিমশিম খাচ্ছে। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। যদি সরকার সহ সমাজের বৃত্তবানরা সহযোগিতার হাত বাড়ায়, তাহলে তার চিকিৎসা হতো ও সংসার চলতে সহজ হতো।

এবিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক জয়নাল আবেদিন জানান, সুজনের শরীরে থাকা প্রতিটি গুলি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এই কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। দেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) রাজীব কুমার সরকার সোনালীনিউজকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা হয়েছে। আহত সুজনের বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি সিভিল সার্জনকেও বলছি এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য।  সুজন কোথায় চিকিৎসা নিয়েছে, এখন কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে তার পরিবারের লোকজন আমার সাথে যেন যোগাযোগ করে। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। এসময় আন্দোলনে আহতদের পাশে থাকবেন বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

উল্লেখ্য, ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের মাদাম ব্রিজ ও তমিজ মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা ও গুলি চালায়। একপর্যায়ে সহযোগীদের নিয়ে নিজের বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলোচিত তাহেরপুত্র একেএম সালাউদ্দিন টিপুর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এতে খালেদ মাহমুদ সুজনসহ শতাধিক আহত ও গুলিবিদ্ধ হন। মারা যান চার ছাত্র। গুলিবিদ্ধ সুজনকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। এ সময় অপারেশনের মাধ্যমে দুইটি গুলি বের করা হয়। তবে এখনো ঘাড়-গলা ও ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ৭টি গুলি রয়েছে। 

এসএস

Wordbridge School
Link copied!