ঢাকা : পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ক্ষিতিশ সরকার। সদ্যই যোগ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরের ডেভেলপমেন্ট শাখায়। সম্প্রতি ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে বের হয়ে রওনা হন গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ের দিকে। সেখান থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব হলেও মিন্টো রোডে ঢুকতেই এক পথচারীকে থামিয়ে বলছিলেন, ‘ডিবি কার্যালয় কোন দিকে? আমি ডিবি কার্যালয়ে যাব।’
টানা দীর্ঘ সময় ঘুরেফিরে ঢাকার বাইরে কর্মস্থল হওয়ায় পরিদর্শক ক্ষিতিশ তেমন পরিচিত নন রাজধানীর সড়ক ও অলিগলির সঙ্গে।
শুধু এ পুলিশ কর্মকর্তাই নন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডিএমপিতে যোগ দেওয়া ৯০ শতাংশ সদস্যরই কর্মস্থল দীর্ঘদিন ছিল ঢাকার বাইরে। তারা চেনেন না রাজধানীর অলিগলি। আর রাস্তাঘাট তেমনটা না চেনায় আসমি ধরা বা মামলার তদন্তের কাজে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে থানা পুলিশের সদস্যদের। প্রায় একই চিত্র ট্রাফিক পুলিশেও।
বেশিরভাগ সদস্যেরই রাজধানীতে এর আগে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় যান চালচল নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যে কারণে রাজধানীর সড়কে এখনো ফেরেনি শৃঙ্খলা। সব মিলিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তিন মাস পার হতে চললেও এখনো রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।
ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর একযোগে সিংহভাগ পুলিশ সদস্যের বদলির পর এখনো পূর্ণ জনবল বুঝে পায়নি ঢাকার থানাগুলো। সর্বস্তরে যাদের বদলি করে আনা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ঢাকায় একেবারে নতুন।
একদিকে কম জনবল, অন্যদিকে ঢাকার বাস্তবতায় অনভিজ্ঞ পুলিশ সদস্যদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। এতে করে মহানগরীতে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে দ্রুতই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবেন বলে আশাবাদী পুলিশ কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্রাফিকে ও মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে এখনো পুলিশ সদস্যরা পূর্ণ উদ্যমে কাজে ফেরেননি। মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তার চলছে ধীরগতিতে। এ অবস্থায় খুন-ডাকাতির পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধও বেড়েছে।
শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে বিপুলসংখ্যক বদলিতে নতুন কর্মস্থলে অচেনা অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে গিয়ে খেই হারাচ্ছে থানা পুলিশ।
এ ছাড়া আগস্টে থানা থেকে লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র এখনো অপরাধীদের হাতে থাকায় উদ্বেগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ডিএমপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৬০টি, এর মধ্যে সেপ্টেম্বরেই হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি।
এ ছাড়া আগস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯, অক্টোবরে ৫৮, মার্চে ১৮, মে মাসে ১৬, এপ্রিলে ১৪, জুনে ১৩, জানুয়ারিতে ১১ ও ফেব্রুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে চারটি। গত ১০ মাসে দস্যুতার ১৮৩, ডাকাতির ২৯, অপহরণের ৮৭ এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি।
এর মধ্যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দস্যুতার মামলা ৩৯, ডাকাতি ১৪, অপহরণের ৪৭ এবং চুরির মামলা হয়েছে ৯৬টি। তবে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় পুলিশের কাছে যান না অনেকেই। এ কারণে অপরাধের সঠিক চিত্র মামলার এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে না।
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘মাসভিত্তিক খুনের মামলার পরিসংখ্যানের হিসাবে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অনেক বেশি মামলা হয়েছে। তবে ওই তিন মাসে খুনের মামলা হয়েছে মানেই ওই মাসগুলোতেই খুনের ঘটনা ঘটেছে এমন নয়। অনেকে বিগত দিনের খুনের ঘটনায়ও মামলা করছেন।’
ডিএমপিতে নিয়োগ পাওয়া একাধিক থানার ওসি জানিয়েছেন, তাদের থানার অধিকাংশ সদস্য ঢাকার বাইরে চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। বাইরে থেকে বদলি হয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের ঢাকার বাস্তবতা বুঝতে এবং অলিগলি চিনতে বেগ পেতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি থানার ওসি বলেন, ‘থানা-ফাঁড়িতে পর্যাপ্ত ফোর্স নেই। ৫ আগস্টের আগের সময়ের তুলনায় বর্তমানে ফোর্সের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। গাড়ির সংকটও প্রবল। যানবাহন সংকটে টহল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মোটরসাইকেল দিয়ে টহল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’
ডিএমপি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকায় যোগ দেওয়া সদস্যদের বেশিরভাগই রাজধানীতে একেবারে নতুন। অত্যধিক কাজের চাপের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাটসহ নিজের নির্ধারিত এলাকা চিনতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। জেলা শহরের অপরাধের ধরন এবং ঢাকার অপরাধের ধরন আলাদা। অপরাধের ধরন বুঝতেই সময় চলে যাচ্ছে। এরপর নতুন জায়গায় চেনাজানা হতেও সময় লাগছে। এ ছাড়া মাঠপুলিশের কাজ অনেকটাই সোর্সনির্ভর। এখনো সেভাবে সোর্স গড়ে ওঠেনি। ফলে কাজে কিছুটা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
সিরাজগঞ্জ থেকে রাজধানীর পল্লবী থানায় বদলি হয়ে আসা এক এসআই বলেন, ‘এলাকার থানায় যত কাজই থাকুক, কিছুই মনে হয়নি। ঢাকায় এসে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে ডিউটি। অল্প কয়েক দিনেই মনে হচ্ছে আর পারব না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবার বদলি নিয়ে চলে যাব।’
রংপুর থেকে বদলি হয়ে আসা আদাবর থানার এসআই আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘অল্প কয়েকজন ছাড়া আমাদের থানার সবাই নতুন। যে কয়েকজন আছে, তারাও চলে যাবে। ঢাকায় অনেক গ্যাদারিং, এখানে অপরাধের ধরনও আলাদা। সবকিছু মিলিয়ে আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে গত সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট ঘিরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটু উন্নতি হলেও সন্তোষজনক নয়। আরও উন্নতি হওয়া দরকার। যেহেতু আপনারা জানেন ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে আমরা চেঞ্জ করছি। তাদের কিন্তু অলিগলি চিনতেও সময় লাগবে। তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে সময় লাগবে। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। সামনের দিকে আরও উন্নতি হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কর্মকর্তা সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ডিএমপির বেশিরভাগ ইউনিট। ডিবি ও ট্রাফিক পুলিশের আটটি বিভাগের সবকটিতে কর্মকর্তাদের সব শূন্যপদ এখনো পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
ডিএমপির ডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিবির কাজ অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য সময়ের প্রয়োজন। তাই পুরোদমে কাজে ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। প্রাথমিক অবস্থায় যেটুকু দরকার, আপাতত সেটুকু দক্ষতা দিয়ে কাজ চলছে।’
ডিএমপিতে জঙ্গিবাদ দমনে রয়েছে বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সেখানেও পরিবর্তন দেখা গেছে। এই ইউনিটের সদস্যরা বম্ব ডিসপোজাল (বোমা নিষ্ক্রিয়) ও সাইবার অপরাধসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ পাওয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ইউনিটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিটিটিসির অধীনে বিভিন্ন ডিভিশনে নতুন অফিসার আসছে। আগের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থাকলেও এখনকার কর্মকর্তারা তেমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। তাই বিশেষায়িত এই ইউনিটের জন্য নতুন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ছাড়া যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এখানে ছিলেন, তাদের বিভিন্ন রেঞ্জ বা জেলা শহরে বদলি করা হয়েছে। সেখানে আগের প্রশিক্ষণ কোনো কাজেই আসবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সিটিটিসি সদস্যদের তখন বেগ পেতে হবে।’
বদলি ও জনবল সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ইসরাইল হাওলাদার বলেন, ‘সংকট হলে একটু সমস্যা হয়। তবে কিছু কিছু রিপ্লেস হয়েছে, যা দিয়ে চালানো যাচ্ছে। খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। আশা করছি আমরা দ্রুত এ সমস্যা সমাধান করে ভালোভাবে পুলিশিং সেবা দিতে পারব।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই