• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১
সিডর দিবস আজ

১৭ বছরেও মুছেনি ক্ষতচিহ্ন, গণকবর ঢেকে আছে ঝোপ-জঙ্গলে


তাপস মাহমুদ, বরগুনা নভেম্বর ১৫, ২০২৪, ০১:২২ এএম
১৭ বছরেও মুছেনি ক্ষতচিহ্ন, গণকবর ঢেকে আছে ঝোপ-জঙ্গলে

ফাইল ছবি

বরগুনা: ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। সেদিন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কয়েকটি জেলাকে লন্ডভন্ড করে দেয় প্রলংয়কারী ঘূর্ণিঝড় সিডর। সেদিন হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ঘূর্ণিঝড়টি। ভয়াল সিডরের ১৭ বছর পার হলেও ঘূর্ণিঝড়টির স্মরণে এখনও চোখে জল চলে আসে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও উপকূলীয় জেলা বরগুনার অপেক্ষাকৃত দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ নদী ভাঙন এলাকাগুলোতে এখনো নির্মিত হয়নি টেকসই বাঁধ। এরমধ্যে অনেক জায়গায় বেড়ি বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান থাকলেও, সেটি চলছে ধীরগতিতে। শুধু তাই নয়, ফি বছর একের পর এক ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও, এই এলাকার মানুষদের জন্য নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো আছে, তার অনেকটাই আবার দূর্যোগের সময় হয়ে পড়ে বসবাসের অনুপযোগী। 

২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মানুষে মানুষে ভরে যায়। পরদিন সকালে বৃষ্টিবাদল না থাকায় নির্ঘুম রাত কাটানো মানুষের অনেকেই নিজের বাড়ি ফিরে যায়। ইতিমধ্যে একটু জিরিয়ে নিয়ে সিডর আবার শক্তি সঞ্চয় করে আরও দুর্বার হয়ে ওঠে। সকাল শেষে ১৫ নভেম্বর ঘোষণা আসে সিডর নামের ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে। সকালে বাড়ি ফিরে যাওয়া মানুষের কাছে এ ঘোষণা ‌‘রাখাল বালকের চিৎকার’ বলে মনে হয়েছিল। তাই অনেকেই আবার বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি।

সন্ধ্যার পর থেকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতি বাড়তে থাকে। রাত যখন বেজে ৯টা, ঠিক তখন বরগুনার পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদের কাছে উপকূল অতিক্রম করে সিডর। সেসময় ঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বরগুনা সহ খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল। ধ্বংসযজ্ঞ চলে বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠিসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলায়।

স্মরণকালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় সিডর মাত্র আধাঘণ্টায় তান্ডব চালিয়ে বরগুনা সহ দেশের গোটা দক্ষিণাঞ্চলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়। লন্ডভন্ড করে দেয় পুরো উপকূল। প্রবল তরে পানি উপচে পড়ে এবং বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে মুহূর্তে চেনা জনপদ পরিণত হয় অচেনা এক ধ্বংসস্তূপে।

সে সময়ের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বরগুনা জেলায় এক হাজার ৩৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১৫৬ জন। বেসরকারি হিসাব মতে ,নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। আহতের সংখ্যা আঠাশ হাজার পঞ্চাশ। দুই লাখ তের হাজার ৪৬১টি পরিবারের আংশিক ক্ষতি হলেও, সাতাত্তর হাজার ৪৫৪টি ঘর বিধ্বস্ত হয়। ফসলের ক্ষতি হয় দুই লাখ তেতাল্লিশ হাজার ৩৯৩ একরের। মৃত্যু হয় প্রায় ৩০ হাজার ৪৯৯ টি গবাদি পশুর। ক্ষতিগ্রস্থ হয় এক হাজার ২৪৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায় ৪২০ কিলোমিটার সড়ক। ক্ষতিগ্রস্থ হয় এক হাজার ৭৯৭ সেতু ও কালভার্ট। অধিকাংশ এলাকায় দেখা দেয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট।

সিডর আক্রান্ত এলাকায় জায়গার অভাবে নিহতদের গণকবর দিতে হয়। অনেক মরদেহের কোনো পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। কাপড়ের অভাবে অনেক মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করা হয়। ঘটনার এক মাস পরেও ধানখেত, নদীর চর, বেড়ীবাঁধ, গাছের গোড়া আর জঙ্গলের নানা আনাচে কানাচে থেকে মরদেহ, দেহের অংশবিশেষ অথবা কঙ্কাল উদ্ধার হয়। কেউ কেউ সিডর আঘাত হানার অনেক দিন পর স্বজনদের কাছে ফিরেও আসেন। স্মৃতি হারিয়ে অনেকেই আর গ্রামের বাড়ি খুঁজে পাননি। তাই ফিরতেও পারেননি পরিবারের কাছে।

ঘূর্ণিঝড় সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানীর সম্মুখীন হয় বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়ন। বিষখালীর নদীর ২২ ফুট জলোচ্ছ্বাসের পানি বেড়ীবাঁধ ভেঙে ও উপচে নিমজ্জিত হয়ে যায়। ৫ ক্যাটাগরির সুপার সাইক্লোন সিডরের ঘণ্টায় ৩০০ মাইল বেগে বাতাসের তান্ডবে দিক হারিয়ে ছুটে চলা বহু মানুষ জলোচ্ছ্বাসে মারা পড়ে। সড়কের পাশে একটু উঁচু জায়গায় ১৯ কবরে ২৯ জনের মরদেহ দাফন করা হয়।

সেই দিনের ভয়াবহ কথা বলতে গিয়ে নলটোনা ইউনিয়নের সেলিম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘সিডর পার হয়ে আজ ১৭ বছর হতে চললো। কিন্তু এখনও বিষখালী নদী পাড়ের মানুষ আতংকে দিন কাটায়। যখনই সাগরে দুর্যোগের কথা শুনতে পায়, তখনই আতংক বেড়ে যায়। এখানে নদী ভাঙনে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয়নি। ক্রমাগত ভাঙনে তিন বেরিবাঁধ বিলীন হয়ে নদী বাড়ির কাছে চলে আসছে। অনেকে এখান থেকে চলে গেছে। বহুবার সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য শম্ভুর কাছে গেছি কিছুই হয়নি। হয়তো দু এক বছরের মধ্যে আমাদেরও চলে যেতে হবে। জিও ব্যাগ ফেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করলেও রাক্ষসী বিষখালীর থাবা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। এইতো গত দুই মাস আগে রাতের দমকা হাওয়ায় বিধবা বয়স্ক নারী রানী বেগমের ঘরটি দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেছে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোন সহায়তা মেলেনি। আসলে নদী পাড়ের মানুষের দুর্যোগে টিকে থাকাতে কেউ এগিয়ে আসে না। সিডর দিবস আসলে পরে  খোঁজ নেয়। গণ কবরে ফুল দিয়ে চলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কথা ভুলে যায়।’ 

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলজুড়ে প্রলংয়করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাথরঘাটা উপজেলায় মারা যাওয়া ৩৪৯ জনের তালিকা করেছিল জেলা প্রশাসন। একাধিক ম্যজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে করা তালিকা অনুযায়ী তাদের পরিবারকে সরকার সাধ্যমতো সহায়তা প্রদান করে এবং পুনর্বাসনে বেসরকারি সংস্থাও সহায়তা করে। তবে এর বাইরে ৪৬ জন জেলে ঝড়ের আগে সাগরে মাছ ধরতে গেলে তারা আর ফিরে আসতে পারেননি। তাদের মরদেহ হয়তো সামুদ্রিক প্রাণির খাবারে পরিণত হয়েছে; সে জন্য তারা মৃতদের তালিকাভুক্তও হননি। তাদের পরিচিতি দেওয়া হয় ‘নিখোঁজ’ বলে। ফলে সরকারি বা বেসরকারি সাহায্যও তারা পাননি প্রত্যাশিত পর্যায়ে। গৃহহীন হয়েও পাননি মাথা গোঁজার মতো একটি রিলিফের ঘর। মেলেনি সরকারের বিধবা ভাতা। চাইতে গেলে তাদের স্বামী যে মারা গেছেন তার প্রমাণ চাওয়া হয়।

বাদুরতলা গ্রামে বাড়ির উঠানে শিশু সন্তান হাসানকে হাঁটিহাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখাতেন জেলে জাকির হোসেন। সিডরের আগে অন্য জেলেদের সাথে সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন জাকির। সেই যে সাগরে মাছ ধরতে গেলেন, আর ফিরে আসেননি তিনি। সেই ছেলে হাসান এখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। মা মর্জিনা বেগম অপরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। বারবার আবেদন ও নিবেদন করেও বিধবা ভাতা পাওয়ার তালিকায় নাম উঠাতে পারেননি তিনি। কিন্তু ছেলেকে পড়াচ্ছেন কলেজে।

মর্জিনা বেগম বলেন, ‘বিধবা ভাতা পেতে হলে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? এখনও আমি ১০ টাকা দরের চালের কার্ড, বিধবা ভাতা এর কিছুই পাইনি।’ 

মর্জিনার মতো এমন বঞ্চিত মা আছেন অনেক। তারা সধবা নাকি বিধবা- তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাননি স্থানীয় চৌকিদার, মেম্বার ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। তাদের স্বামীদের নাম ওঠেনি মৃত্যু নিবন্ধন তালিকায়।

একই গ্রামে লাভলী বেগমের স্বামী ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ তালিকায়। নিখোঁজ স্বামী জাকির হোসেনের স্ত্রী মাসুরা। তিন সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে চলছে তার দিন। তিনিও পান না কোনো ভাতা।

কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বকুলতলা গ্রামে বাস করেন পুতুল রানী। স্বামী হারানোর পর তার আশ্রয় হয় বাপের বাড়িতে। তার স্বামী র্নিমল মিস্ত্রি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে সাগরে মাছ ধরতে যান। এরপর থেকে নিখোঁজ। ‘গত ১৭ বছরের প্রতিটি দিন, মাস ও বছর কীভাবে পার করেছি তার বর্ণনা  দিতে গেলে মহাভারত লেখা হয়ে যাবে’- দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলেন পুতুল রানী। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তিনি বলেন, ‘কত যে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা সৃষ্টি কর্তাই জানেন’। 

এব্যাপারে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাকিব বলেন, বরগুনা জেলায় মোট ৮০৫ কিলোমিটার জুড়ে মাটির বেড়ি বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার স্থায়ী ব্লক নির্মিত বাঁধ রয়েছে। আরও সাড়ে আট কিলোমিটার কাজ চলমান। দুটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৬৫ কিঃমিঃ চলমান রয়েছে। 

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় কাজ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জেলা প্রশাসন তাগিদ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ইতিমধ্যে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট বরগুনার বেড়ি বাঁধ সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বরগুনায় ৬৭৩টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। কিছু আশ্রয় কেন্দ্র সরকারের কিছু বেসরকারি পর্যায়ে। অনেক আশ্রয় কেন্দ্র পুরাতন হওয়ায় মেরামত যোগ্য হয়ে পড়েছে। সরকারের এ বিষয়ে কোন বরাদ্দ নেই। আমরা এরপরেও তালিকা করে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলে এগুলোর মেরামত করা হবে। এছাড়া স্থানীয় বরাদ্দ থেকেও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত করা হবে।

সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘সিডর’। বাংলাদেশে সিডরের আগে যে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত করেছিল, সেগুলোর কোনো নাম ছিল না। এর আগের বড় ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এ অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে, তার নাম দেওয়া হয় ২০০৪ সালে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম অনুসারে সিডরের নামটি ঠিক করে, যার অর্থ চোখ। 

এসএস

Wordbridge School
Link copied!