• ঢাকা
  • বুধবার, ০৯ এপ্রিল, ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি জোরালো করবে দলগুলো


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ৪, ২০২৫, ১০:৫৯ এএম
নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি জোরালো করবে দলগুলো

ঢাকা : বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধোঁয়াশা রয়েছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে নির্বাচনের ইস্যুতে ঐকমত্যের অভাবও দেখা গেছে। 

মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এ বছর (২০২৫) ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট। 

তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাস, কিন্তু এখনো কোনো রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়নি। আমরা স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি।’ 

অন্যদিকে, নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেন, ‘সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।’

এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন একটি দাবির কথা উঠে এসেছে, যেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (উত্তরাঞ্চল) এই দাবি করেন। তার মতে, ‘ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন থাকবে।’ 

সর্বশেষ জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন মুসল্লিদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলেন তখনো এই দাবির পুনরাবৃত্তি ঘটে অনেক উপস্থিতজনের মুখে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে এই দাবি উঠে আসতে পারে, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা হতে পারে। 

এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, এই সরকারের মেয়াদ বাড়ানো দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বিএনপির অন্তত দুজন সিনিয়র নেতার মতে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হলে এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো মৈত্রী তৈরি না হলে সঙ্গত কারণেই জামায়াত ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়বে। এ অবস্থায় জামায়াত চায় না শিগগিরই নির্বাচন হোক। ছাত্রদের জামায়াত প্রভাবিত অংশটিও নির্বাচন চায় না। তাদের সঙ্গে কিছু বুদ্ধিজীবীও নির্বাচন চান না। এ কারণে তারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচারণা শুরু করেছে।

আর বিশ্লেষকদের মতে, এই সরকার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই জামায়াত ও ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সরকারের অতিরিক্ত সখ্যের কারণে উদারপন্থিরা সরকারের কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের আঙুল ফুলে কলাগাছ ধরনের উত্থান এবং নিজেদের মধ্যে নানা রকমের বিভাজনের কারণে ছাত্রদের জনপ্রিয়তাও দিন দিন কমছে। নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানা ঘটনা সমাজে গভীর ভীতি তৈরি করেছে। 

সারা দেশে মাজার ভাঙচুর, গানের অনুষ্ঠান বন্ধ, শিল্পীদের প্রতি হুমকি-ধমকিতে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যাতে মনে হয় দেশে ইসলামপন্থি উগ্রবাদের জাগরণ ঘটেছে। বিশেষ করে যত্রতত্র মব তৈরি করার মধ্য দিয়ে যেভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে বহু মানুষ উদ্বিগ্ন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল সরকার চায়। সেনাবাহিনীও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় বলে বারবার জানিয়েছে।

ফলে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচন আয়োজন প্রাধান্য পাওয়া উচিত। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করলে সেই সরকার সব দিক থেকে জাতীয় সরকার হবে বলে বিএনপি বারবার বলে এসেছে। সেই সরকারেও ড. ইউনূসের দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে ভাবমূর্তি বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে তাতে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। তিনি তার কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে তাকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার চেষ্টা হিতে বিপরীত হবে।

সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করতে বিএনপির নেতারা আগে থেকেই বিভিন্ন বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। ঈদের আগের দিন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকার নিরপেক্ষতা হারালে বিএনপি তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। 

আমরা সরকারের পূর্ণ নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করি, বিশেষ করে অধ্যাপক ইউনূসের কাছ থেকে। যদি প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেন, তাহলে জনগণের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হবে যে, এ সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমাদের হতাশ করেছে। কিছু উপদেষ্টার কার্যক্রম দেখে আমরা সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করছি।’

চট্টগ্রামে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের কুশল বিনিময়ের সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘একটি শক্তি ক্ষমতায় থাকার জন্য নতুন নতুন পন্থা বের করছে; কিন্তু ফ্যাসিস্টরা দাঁড়াতে পারেনি। এই শক্তিও যাতে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত রয়েছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. আবদুল মঈন খান যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন না হলে ‘জনগণের মধ্যে জোরালো অসন্তোষ’ এবং দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে বলে সতর্ক করেছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য এতদিন ধরে তারা সরকারের কাছে যে আহ্বান জানিয়ে আসছেন, ঈদের পর তা আরেকবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চান। ফরমালি হয়তো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আহ্বান জানাব। উনি কী পদক্ষেপ নেন এবং কী ঘোষণা দেন, সেটার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করব আমরা। এরপরও প্রত্যাশিত ঘোষণা না এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরব।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যদি একেক সময় একেক কথা বলেন, দেখতে হবে উনি কেন এভাবে বলছেন? আমরা আগে ওনার সঙ্গে কথা বলে নেব। তার পরিপ্রেক্ষিতে উনি কী করেন, সেটা দেখব। তারপর আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য মাঠে-ময়দানে, জনগণের কাছে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তুলে ধরব।’

১৬ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘অহেতুক কোনো বিলম্ব না করে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন, সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই সরকারের ব্যর্থতা আমরা চাই না। সরকার যাতে বোঝে সেটা চাইছি। দেশের মানুষের মনের আকুতি মোতাবেক জাতীয় ঐক্য নিয়ে সরকার যেন কাজ করে এবং দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সম্মানের সঙ্গে তাদের বিদায় নেওয়ার আহ্বান জানাই।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘মানুষ এই সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর মনে করায় নৈরাজ্যের বিস্তার ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের সাত মাসেও মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি। এ অবস্থা চলতে দিলে জনগণের জানমাল আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। তাই এ সরকারের সময় বাড়ানোর যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেটি না করাই উত্তম। বরং সরকারকে তাদের এজেন্ডা সীমিত করে অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণের আহ্বান জানাই। দড়ি নিয়ে বেশি টানাটানি না করতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।’

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে অতীতের মতো সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামব।’

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা হলে তা প্রধান উপদেষ্টার জন্য একটা সম্মানজনক বিষয় হতে পারে। নির্বাচনের সময়সীমা স্পষ্ট করা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হতে পারে, যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।’ সূ্ত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!