• ঢাকা
  • বুধবার, ০৯ এপ্রিল, ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১
মোটা অঙ্কের অর্থ খরচের অভিযোগ

৬২ মামলার আসামি বেসিকের বাচ্চু লন্ডনে!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৫, ২০২৫, ১২:২৭ পিএম
৬২ মামলার আসামি বেসিকের বাচ্চু লন্ডনে!

ঢাকা : পুলিশ এখনো জানে না রাষ্ট্রীয় মালিকানার বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু কোথায়। তার বিরুদ্ধে ৬২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ৫৮ মামলায় চার্জশিট দিয়েছে সংস্থাটি। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।

তবে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, মাস ছয়েক আগে দেশ ছেড়েছেন তিনি। এখন আছেন লন্ডনে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রীয় মালিকানার এই ব্যাংকের আমানতের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটের পর তাকে গত দুই বছরেও গ্রেপ্তার করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও দুদক। তাকে বিচারের আওতায় আনার জন্য কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা নেই।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই গত বছরের ১২ জুন বাচ্চুর বিরুদ্ধে ৫৮ মামলায় চার্জশিট দেয় দুদক। ওই বছরের ২১ জুন তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।

দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু কোথায় আছেন কেউ জানেন না। তবে তিনি দেশে নেই বলে মনে করা হচ্ছে। আদালতে দেওয়া দুদকের আবেদনে তার দেশে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। চার্জশিট দেওয়ার পর বাচ্চুকে গ্রেপ্তারে কিছুটা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন দুদক কর্মকর্তারা।

বাচ্চুর বিষয়ে তৎপরতা নেই কর্তৃপক্ষের : আদালত থেকে তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বহিরাগমন শাখাসহ (ইমিগ্রেশন শাখা) সব বন্দর কর্তৃপক্ষকে দুদক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

আদালতে দেওয়া আবেদনে দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম উল্লেখ করেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতিসহ ব্যাংকের প্রায় ২ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ এবং আত্মসাতে সহায়তার অপরাধে সর্বমোট ৫৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়।

দীর্ঘদিনেও সন্ধান নেই : দুদক সূত্র জানায়, বাচ্চুর অনুপস্থিতিতেই বিচার হবে। বাচ্চু আইনের চোখে পলাতক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে।

২৯ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান জানান, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু কোথায় আছেন আমরা সত্যিই জানি না। আমরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তার বাসায় অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু পাইনি। তিনি বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে দেশত্যাগ করেননি। তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদি কোনো বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন, তাহলে আমরা জানতে পারব। সে কারণেই আমরা মনে করি, তিনি এখনো বাংলাদেশেই আছেন।

তিনি জানান, আট বছর তদন্ত করার পর আমরা বাচ্চুর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পল্টন থানায় দায়ের করা একটি দুর্নীতির মামলায় এ পরোয়ানা দেওয়া হয়।

এর আগে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় দায়ের করা আরও দুটি মামলায় তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয়। মামলার নথি থেকে জানা যায়, বাচ্চুর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায়। আর তার বর্তমান বাসা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়।

দুই বছরেও গ্রেপ্তার হয়নি : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বাচ্চুর ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর পর থেকে দেশের সীমান্ত এলাকা, স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বহিরাগমন শাখাসহ (ইমিগ্রেশন শাখা) সব বন্দর কর্তৃপক্ষ তৎপরতা শুরু করে।

এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির বাচ্চুর ৭৩ সহযোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা যাতে বিদেশে পালাতে না পারে তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে দুদক। তাদের হদিস পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

চার্জশিটে নাম আসার আগেই চম্পট : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুদকের চার্জশিটে নাম আসার বহু আগে থেকে বাচ্চু গা ঢাকা দেন। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

তিনি রাজধানীর বনানীর বাড়ির সবকটি ফ্ল্যাট বিক্রি ও গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের অনেক সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে টাকা পাচার করে দিয়েছেন। তবে দুদকের পক্ষ থেকে তার বাগেরহাটের বাড়িটি তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কানাডা ও লন্ডনে আছে বিলাসবহুল বাড়ি : দুদকের গোয়েন্দারা জানান, ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল আবদুল হাই বাচ্চু দুবাই যান। সেখান থেকে তিনি কানাডায় যান। কানাডায় তার বাড়ি-গাড়িসহ বিশাল সম্পদ রয়েছে। লন্ডনেও আছে কয়েকটি বাড়ি।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাচ্চু দেশেই ছিলেন। আমার তথ্যমতে, মাস ছয়েক আগে তিনি ভারত হয়ে লন্ডন যান। এর মধ্যে তিনি একবার কানাডায় আসেন। দেশ থেকে পালিয়ে যেতে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করেছেন। তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে।

৪৫০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাচ্চু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান থাকাকালে বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার হয়। সবগুলো টাকাই দেশের বাইরে পাচার করা হয় বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন।

২০১৪ সালের ১৪ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুদককে একটি প্রতিবেদন দেয়, যেখানে শেল কোম্পানি ও সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কীভাবে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাচ্চু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কার্যক্রমে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করেন এবং কর্মকর্তাদের সুপারিশ উপেক্ষা করে অনেক ঋণ অনুমোদন করেন। জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে ঋণও অনুমোদন করেন।

গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে বাচ্চু তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়েছিলেন।

তার আইনজীবী জানান, তিনি আদালতের কাছে দাবি করে যাচ্ছেন যে তিনি নির্দোষ এবং তার বিরুদ্ধে কোনো বস্তুগত প্রমাণ নেই।

কীভাবে সোনার হরিল পেলেন বাচ্চু : ২০০৯ সালের আব্দুল হাই বাচ্চু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসিক ব্যাংকে চেয়ারম্যানের লোভনীয় পদ পান। তার কাজ ছিল সরকারি এই ব্যাংকটি যাতে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে কোনো অনিয়ম না করে, ব্যাংকিং নীতি মেনে আমানতকারীদের স্বাক্ষর করে তা তদারকি করা।

ব্যাংকটিকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করে আমানতকারীদের স্বার্থসংরক্ষণ করা। তার কালো থাবায় ঘটল উল্টো। তিনি পুরো ব্যাংকটিকে তার পারিবারিক সম্পদে পরিণত করলেন। টাকার নেশায় তিনি নজিরবিহীনভাবে লুটপাট শুরু করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ, মূলধন পর্যাপ্ততা, মুনাফা অর্জনসহ সার্বিক বিবেচনায় এক সময় বেসিক ব্যাংক ছিল এ খাতের ঈর্ষণীয় কাতারে। এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি ছিল লোভনীয়। তবে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর ব্যাংকটিতে নানা অনিয়ম শুরু হয়। যে ব্যাংকটিকে দেশের সবচেয়ে খারাপ ব্যাংকের উদাহরণ বানিয়েছেন।

তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত। এ সময়ে ব্যাংক থেকে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

পুকুর চুরির ঘটনা যেভাবে বেরিয়ে আসে : দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালে দুদকের দায়ের করা কোনো একটি মামলাতেও বাচ্চুর নাম ছিল না। যদিও মামলার পর দুদক থেকে বরাবরই বলা হচ্ছিল তদন্তে তার অপরাধ ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখা হবে। উচ্চ আদালত থেকেও দুদককে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছিল। কেন বেসিক ব্যাংক মামলায় আসামি করার ক্ষেত্রে দুদক পিক অ্যান্ড চুজ নীতি নিয়েছে সেই প্রশ্নও তোলে আদালত। এভাবে ৮ বছর কেটে যায়।

এরপরই গত ১২ জুন বেসিক ব্যাংকের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক।

সংস্থাটির দায়ের করা মোট ৫৯ মামলার চার্জশিটের মধ্যে ৫৮টি মামলার তদন্তে নতুন আসামি হিসেবে আলোচিত আবদুল হাই বাচ্চু ও কোম্পানি সচিব শাহ আলম ভূঁইয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনুমোদিত চার্জশিটে তার ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ৪৬ জন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহকসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি রয়েছেন। যেখানে ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়।

আর ডিএমডি ফজলুস সোবহান ৪৭টি, কনক কুমার পুরকায়স্থ ২৩টি, মো. সেলিম আটটি, বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খানকে ৩৫টিতে আসামি করা হয়েছে। সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!