• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

যুবাদের ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের বিশ্বজয়


ক্রীড়া প্রতিবেদক ডিসেম্বর ২৭, ২০২০, ০১:১১ পিএম
যুবাদের ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের বিশ্বজয়

ঢাকা : ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার পঙক্তিগুলোই যেন গর্জন রূপে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় হৃদয়ে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল। ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান বিশপের কণ্ঠে শোনা গেল- ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী হবে উৎসবের নগরী’।

লাল-সবুজের দলের এমন জয়ের পর উল্লাসের বাধ ভেঙে গিয়েছিল। এ চিৎকারে কেঁপে ওঠে বিশ্ব। কারণ একটাই, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ!

সুশান্ত মিশ্রর করা বল ডিপ মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে এক রান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বিজয় অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পেয়ে যায় বিশ্বজয়ের স্বাদ। আলোকজ্জ্বলতায় পরিপূর্ণ হয়ে বিশ্বজয়ের মালা পরে টাইগার যুবারা উদযাপনে ব্যস্ত থেকে দেশের মানুষকে দেখিয়েছেন কীভাবে পৃথিবীর বুকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে তা উপভোগ করতে হয়।

মাশরাফী-সাকিব-তামিম-মুশফিক-রিয়াদরা যা পারেননি; তা পেরেছেন আকবর আলী, তৌহিদ হৃদয়, তানজিদ হাসান তামিমরা। ওই ১১ জনের হাত ধরে আসা বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে উপলক্ষটা এনে দিয়েছিল, তা আসলেই বিশাল। বিশ্বকাপ জয়ের পরদিন বিসিবি কার্যালয়ে জড়ো হওয়া সাংবাদিকরাও আগে এমন আনন্দমুখর পরিবেশে কখনোই সংবাদ সংগ্রহ করতে আসেননি।

বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও হয়তো সেদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খুশিতে এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, শুধু ক্রিকেট না এটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, রাতারাতি কিছু আসেনি। গত ১৮ মাস থেকে সুপরিকল্পনা, অনেকগুলো ম্যাচ আয়োজন করার ফল পেয়েছি আমরা। বাংলাদেশের এই দলকে কিন্তু সবাই গোনায় ধরেছে। সেমিফাইনাল খেলবে সবারই ধারণা ছিল। বিদেশের মাঠে আমরা ভালো খেলিনি। এই ছেলেরা এটাও ভুল প্রমাণ করেছে।

নাজমুল হাসান পাপনের কথার যথার্থতা প্রমাণ করছে পরিসংখ্যান। বিশ্বকাপের জন্য এক বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছে আকবর আলীরা, দেশ-বিদেশ মিলিয়ে বেশকিছু সিরিজে ৩০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে টাইগার যুবারা।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে ৪-১ ব্যবধানে জয়, ইংল্যান্ডকে তাদের মাঠে তিনবার হারানো, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জয়, এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলা। নিজেদেরকে সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রস্তুত করেছিল বিশ্বজয়ী ক্রিকেটাররা। ১৬ দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত যুব বিশ্বকাপে সি গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গী হয়েছিল পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে ও স্কটল্যান্ড।

রোড টু চ্যাম্পিয়নশিপ 

বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে : নিজেদের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করা জিম্বাবুয়ে ২৮.১ ওভারে ৬ উইকেটে ১৩৭ রান করার পর বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। পরে বৃষ্টি আইনে বাংলাদেশের জয়ের জন্য ২২ ওভারে ১৩০ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায়। মাত্র ১১.২ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে টাইগাররা জয় নিশ্চিত করে। সদ্য শেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে সেঞ্চুরি হাঁকানো পারভেজ হোসেন ইমন এই ম্যাচে ৫৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন।

বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড : শক্তির বিচারে স্কটল্যান্ডের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে তাদের বিপক্ষে অনায়াসে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে। বল হাতে স্কটিশদের ৩০.৩ ওভারে মাত্র ৮৯ রানে গুঁটিয়ে দেয় টাইগাররা। বাঁ হাতি অর্থোডক্স স্পিনার রাকিবুল হাসান পেয়ে যান হ্যাটট্রিক। কেস সাজ্জাদকে ৭ রানের বেশি করতে না দিয়ে বোল্ড করেন রাকিবুল। পরের বলে লেইল রবার্টসনকে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলেন রাকিবুল। চার্লি পিটকে পরের বলে বোল্ড করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন তিনি। জবাবে ১৬.৪ ওভারে ৭ উইকেট হাতে রেখে লাল-সবুজের বিজয় নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান : গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে ২৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই নিজেদের প্রস্তুত করেছিল টাইগার যুবারা। তবে যমজ সন্তান জন্ম দেয়ার সময় অধিনায়ক আকবর আলীর বোনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর গোটা দল ম্যাচের আগে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যদিও বোনের মৃত্যুতে দমে যাননি আকবর।

শোককে পরিণত করেছে শক্তিতে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ঠিকই মাঠে নেমেছিলেন। তবে ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতার ছিল না। বৃষ্টির কারণে ৩৭ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে আগে ব্যাট করা টাইগাররা ২৫ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১০৬ রান করে। তবে ভাগ্য সহায় ছিল যে এরপর আবারো বৃষ্টি নামায় বল আর মাঠে গড়ায়নি। ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পয়েন্ট সমান ৫ হলেও রান রেটে এগিয়ে থাকায় আকবর আলীরাই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ আটে ওঠে।

বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা (কোয়ার্টার ফাইনাল) : ওপেনার তানজিদ হাসান তামিমের ৮০, শাহাদাত হোসেনের অপরাজিত ৭৪ এবং তৌহিদ হৃদয়ের ৫১ রানের ইনিংসে ভর করে কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ উইকেটে ২৬১ রানের বড় স্কোর পায় বাংলাদেশ। জবাব দিতে নামা প্রোটিয়াদের ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামান স্পিনার রাকিবুল হাসান। ৯.৩ ওভার বল করে মাত্র ১৯ রান দিয়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। তাতে স্বাগতিকরা মাত্র ১৫৭ রানে অলআউট হলে ১০৪ রানের বড় জয় পেয়ে সেমিফাইনালের টিকেট কাটে টাইগার যুবারা।

ম্যাচ শেষে প্রখ্যাত ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার, বিশ্লেষক এবং সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যালান উইলকিন্স বাঘ শাবকদের শেষ চারে পৌঁছানোর পর কিউই সমর্থকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে জোরালোভাবেই বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ।  

বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড (সেমিফাইনাল) : টসে জিতে আগে ফিল্ডিং বেছে নেয়া বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণ করেন বোলাররা। উলার গ্রিনালের অপরাজিত ৭৫ রানের ইনিংসে ভর করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২১১ রান তোলে নিউজিল্যান্ড। এরপর কিউইদের দেয়া মামুলি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৩২ রানেই ২ উইকেট হারায় টাইগাররা। এরপর শুরু হয় মাহমুদুল হাসান জয়ের দৃঢ়তা। তৌহিদ হৃদয়ের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যান তিনি। হৃদয় ৪০ রানে ফিরে গেলেও লড়তে থাকেন জয়। তাকে সঙ্গ দিয়ে যান শাহাদাত হোসেন। ঠিক ১০০ রান করে জয় আউট হলেও আকবরকে নিয়ে ৩৫ বল ও ৬ উইকেট হাতে রেখেই বাংলাদেশকে ফাইনালে তুলেই মাঠ ছাড়েন ৪০ রান করা শাহাদাত।

বাংলাদেশ-ভারত (ফাইনাল) : ম্যাচের একেবারে শুরুটা বাংলাদেশের। ভারতকে চেপে ধরে সপ্তম ওভারেই স্কোরকার্ডে ৯ রানে থাকতেই প্রথম উইকেট তুলে নেয়া, ফাইনালের একাদশে সুযোগ করে নেয়া অভিষেক দাসের কল্যাণে।

এরপর খানিক কক্ষপথে ফেরার চেষ্টা ভারতের, তীলক বর্মাকে সঙ্গী করে জীবনযুদ্ধের সংগ্রামে জয়ী যশাওয়ালের। বার্মাকে সাজঘরের পথ দেখিয়েছেন তানজিম হাসান সাকিব, ভাটা পড়ে ভারতের রানের চাকায়। তবে দমে যাননি যাশওয়াল। ৮৮ রানে তানজিদ হাসানের ক্যাচ বানিয়ে তাকে আউট করেছেন শরিফুল ইসলাম।

এরপর বাংলাদেশের বোলারদের জেগে ওঠা ও ভারতের ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করার পালা শুরু হয়। যাশওয়াল আর বর্মার পর দুই অংকে পৌঁছান কেবল জুরেল। আর কেউ দুই অংক ছুঁতে পারেননি। ভারত তাতে ১৭৭ রানেই অলআউট হয়ে যায়।

বল হাতে ৩ উইকেট নেন অভিষেক, শরিফুল ও সাকিব দুইটি ও রাকিবুল নেন একটি উইকেট। তবে এদিন বাংলাদেশ দল যে অভাবনীয় ফিল্ডিং প্রদর্শন করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা আসলেই কথন। কোনো প্রশংসাই আসলে ফিল্ডিংয়ের মাহাত্ত বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়।   

তামিম ও ইমন উদ্বোধনী জুটিতে ৫০ রান তুলে দলকে সহজ জয়ের দিকেই নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হ্যামস্ট্রিকে চোট পেয়ে দুই দফায় মাঠে নেমে ইনিংস সর্বোচ্চ ৪৭ করেছেন ওপেনার তানজিদ হাসান ইমন। জয়ের লক্ষ্যটা বড় না হলেও রবি বিষ্ণু একাই চার ব্যাটসম্যানকে তুলে নিলে ৬৫ রানেই বাংলাদেশের ৪ উইকেট পড়ে যায়।

কোটি বাংলাদেশির তখন দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়, পেয়ে বসেছিল হারের শঙ্কা। তা হতে দেননি আকবর আলী। নিজের মর্ম বুঝিয়েছেন, ঠাণ্ডা মাথায় ফিরেছেন ম্যাচ জিতিয়ে। তাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সঙ্গ দিয়েছেন পারভেজ হোসেন ইমন। বল হাতে ঝলক দেখানো রাকিবুল ব্যাট হাতে অভয় দিয়েছেন। মাঝে বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধের পর টাইগারদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। আকবর বীরচিত ইনিংস আকবর জিতিয়েছেন দলকে।

ঠাণ্ডা মাথায় মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে খুন করেছেন প্রিয়াম গার্গদের হৃদয়, ঘটিয়েছেন রক্তক্ষরণ, চোখ ভাসিয়েছেন জলে। ৭৭ বলে ৪ চারে ১ ছক্কায় করেছেন ৪৩ রান।

উইনিং শট আসে রাকিবুলের ব্যাটে, আর তখনই ডাগ আউট থেকে বাংলাদেশ দলের সবার মাঠে প্রবেশ করে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠা। পুরো দেশ ভেসেছে উৎসবের বৃষ্টিতে। বোন হারানোর বেদনা হৃদয়ে পুষে রেখে ইস্পাতের স্নায়ুতে ম্যাচ জয়ে সামনে থেকে ভূমিকা রাখা অধিনায়ক আকবর প্রশংসায় ভেসে যান। টাইগার ক্যাপ্টেনের ছবি দিয়ে অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘আকবর দ্য গ্রেট’।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!