ঢাকা: ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করার যে চাপ, কোনো খেলার কোনো অধিনায়ককেই সম্ভবত তা নিতে হয় না। এ নিয়ে অস্বস্তি ছাড়া অধিনায়কত্ব নিতে রোহিত শর্মার অনাগ্রহের আর কী কারণ থাকবে! সেই চাপকে জয় করার প্রমাণ পরিসংখ্যানে। অধিনায়কত্ব রোহিত শর্মার ব্যাটিংয়ে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। ভুল বলা হলো। ফেলেছে, তবে তা ইতিবাচক অর্থে। যে ৪৩টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে অধিনায়ক রোহিত শর্মার ব্যাটিং গড় ৫৫.৮০। ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৯.১৪। স্ট্রাইক রেটও জানিয়ে দিচ্ছে, আরও বেশি মন খুলে খেলার কথা, যা প্রায় ১৮ বেশি (ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৯১.৬৩, অধিনায়ক হিসেবে ১০৯.২২)।
এই স্ট্রাইক রেটের হিসাবটা এবারের বিশ্বকাপের রোহিত শর্মাকে বুঝতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। রান খারাপ করেননি, বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৪ নম্বরে তার নাম। তবে এখন পর্যন্ত ভারতের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় রানসংখ্যার চেয়ে বড় ভূমিকা অধিনায়ক যেভাবে তা করেছেন। এই বিশ্বকাপে রান করেছেন ১২১ স্ট্রাইক রেটে। ৪০০-এর বেশি রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি।
চলতি বিশ্বকাপে ভারতের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার কারিগর রোহিত শর্মা হলেও আসল নায়ক কিন্তু তিনি নন। কারণ এই গল্পের নায়ক একজনই তিনি রাহুল দ্রাবিড়।
১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের কোনো কোচ ছিল না। পিআর মানসিং ম্যানেজার হিসেবে সেবার একাই দলটাকে সামলেছিলেন। আর ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের কোচ ছিলেন গ্যারি কার্স্টেন। ভারতের তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পথে তাই প্রথম বারের মতো প্রধান কোচের আসন অলঙ্কৃত করার দিকে হাঁটছেন ভারতীয় কোনো কোচ। তিনি রাহুল দ্রাবিড়।
বয়সভিত্তিক দলকে দীর্ঘদিন কোচিং করিয়েছেন দ্রাবিড়। এরপর ভারত এ দল সহ, আইপিএলেও কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছিল তার। রবি শাস্ত্রীর পর তাই ভারতের প্রধান কোচ হওয়ার দৌঁড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। যদিও ভারতের ডাগআউটে বসার আগেই অসম এক চাপ সঙ্গী হয়েছিল তার উপরে। দীর্ঘদিন ধরে আইসিসির শিরোপার দেখা নেই। দল গুছিয়ে নেওয়ার আগেই এমন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তিনি।
আর সেই পথযাত্রায় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনাল কিংবা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল হেরে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। তবে ভারতীয় ক্রিকেট পাড়ায় সেই আলোচনা-সমালোচনা টলাতে পারেনি তাকে। কোনো চাপে নুয়ে পড়েননি তিনি। ভারতের হয়ে নিজের কাজটা করে গিয়েছেন একাগ্রচিত্তে। জানতেন, সহসাই সাফল্য পাবেন না। তবে সাফল্যের পথে ছোটার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে গিয়েছেন। আর সেই চেষ্টারই ফল পাচ্ছেন এবারের বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চে এসে। ভারত ছুটছে দুর্দান্ত গতিতে।
ফিটনেস ইস্যুতে ভারত কঠিন অবস্থানে, বেশ কিছু বছর আগে থেকেই। তবে ভারতের কোচ হওয়ার পর রাহুল দ্রাবিড় খেলোয়াড়দের ফিটনেসের পাশাপাশি মানসিক শক্তিও বাড়াতে বলেছিলেন। কেননা, বিগত আসরগুলোতে ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথযাত্রায় যে ব্যর্থতার গল্পগুলো লিখেছে, তার মূলে ছিল এই মানসিক শক্তির অভাব।
এ ছাড়া অধিক আত্মবিশ্বাসও ভারতের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে ছিল অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। তবে রাহুল দ্রাবিড়ের দল সেই ভুল থেকেই এবার শিক্ষা নিয়েছে। দলে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না, তবে তা অতিরঞ্জিত হয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকার মতো নয়। খেলোয়াড়দের মধ্যে শিরোপা জয়ের একটা ক্ষুধা তৈরি হয়েছিল। আর সেই ক্ষুধাটা তৈরি করেছিলেন রাহুল দ্রাবিড়।
দল নির্বাচনেও রাহুল দ্রাবিড় দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা। কখনো দুই পেস বোলিং অলরাউন্ডার দিয়ে তৃতীয় পেসারের অভাব পূরণ করেছেন। আবার কখনো বা তৃতীয় পেসারকেও দলে ভিড়িয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপ চলাকালীনই ভারত শিবিরে দেখা দিয়েছিল ইনজুরির হানা। হার্দিক পান্ডিয়া গোড়ালির চোটে পড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান। তবে তার অনুপস্থিতি দলকে একটুও ভোগায়নি।
কারণ তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে একাদশে সুযোগ পেয়ে রীতিমত উড়ছেন মোহাম্মদ শামি। আর পান্ডিয়ার পাওয়ার হিটিংয়ের অভাব পূরণ করছেন সূর্যকুমার যাদব।
এ ছাড়া বিশ্বকাপকে সামনে রেখে রাহুল দ্রাবিড় নির্দিষ্ট পজিশন নিয়ে অনেক কাঁটাছেড়া করেছেন। এই যেমন শ্রেয়াস আইয়ার আর লোকেশ রাহুল এশিয়া কাপের আগ অবধি বেশ কয়েক মাস ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। সেই সময়টাই তিনি বেশ কজন মিডল অর্ডারকে পরখ করেছেন। এরপর লোকেশ আর আইয়ার যখন ইনজুরি কাটিয়ে ফিরলেন তখন রাহুল দ্রাবিড় ভরসা রেখেছেন তাদের উপরেই। আর তার সেই আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন দুজনই। দুজনই এবারের বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি পেয়েছেন। শ্রেয়াস আইয়ার তো সেমি পর্যন্ত ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।
ভারত বিশ্বকাপ জিতবে কি জিতবে না, তা সময়ই বলে দিবে। তবে ভারতের এই অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় যে আড়ালের নায়ক হয়ে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, সে কথা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ভারতীয় কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। নিশ্চিতভাবেই, বিশ্বকাপ জেতার এত কাছ থেকে ফিরে যেতে চাইবেন না তিনি।
এআর