ঢাকা : নাসাউ কাউন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যখন ভারত-পাকিস্তান মহারণ চলছে, মাইল পাঁচেক দূরত্বের ক্যান্টিয়াগ পার্কে তখন অনুশীলন করছে বাংলাদেশ দল। নাসাউ কাউন্টি পরিচালিত এই পার্কটি খেলাধুলার স্বর্গরাজ্য বলা যায়।
পাঁচটি টেনিস কোর্ট, বেসবল টার্ফ, সফটবল মাঠ, কয়েকটি বাস্কেটবল কোর্ট, ছয়টি হ্যান্ডবল ও প্যাডলবল কোর্ট, বেসবল ও সফটবেল কেইজ, বিভিন্ন মাল্টিপারপাজ টার্ফ, গলফ কোর্স, সুইমিং ও ডাইভিং কমপ্লেক্স, আইস স্কেটিং রিঙ্ক, উন্মুক্ত আরও কিছু মাঠ… কী নেই এখানে! বিশাল এই আঙিনার এক কোনায় জায়গা পেয়েছে ক্রিকেটও।
মূলত বিশ্বকাপ দলগুলির জন্যই নেট অনুশীলনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লড়াইয়ের আগে রোববার এখানেই ছিল বাংলাদেশ দলের অনুশীলন সেশন।
ম্যাচের আগের দিন এমনিতে মূল ভেন্যুতে অনুশীলন করতে চায় সব দলই। তবে নিউ ইয়র্কের ম্যাচের জন্য ক্যান্টিয়াগপার্কে অনুশীলনেও আপত্তির কারণ নেই খুব একটা। এই দুই জায়গার উইকেটের জন্ম যে একই সঙ্গে!
অ্যাডিলেডে যে ১০টি ড্রপ-ইন পিচ তৈরির পর জাহাজে করে ফ্লোরিডায়এনে সেখানকার উষ্ণ রোদ-বাতাসে পরিচর্যা করে শেষ পর্যন্ত ট্রেইলারে করে নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসা হয়েছে, সেই পিচগুলির চারটি বসানো হয়েছে নাসাউ কাউন্টি মাঠে, বাকি ছয়টি এই ক্যান্টিয়াগের অনুশীলন প্রাঙ্গনে। সব উইকেটের চরিত্র তাই একই রকম হওয়ার কথা।
উইকেট নিয়ে এত কথা বলার কারণ, এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় তো নিউ ইয়র্কের উইকেটই। অসম বাউন্সের বিপজ্জনক এই উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়ে উঠেছে মৃত্যুকূপ। এই মাঠে আসরের প্রথম দুই ম্যাচে আগে ব্যাট করা দল গুটিয়ে গেছে ৭৭ ও ৯৬ রানে। পরের তিন ম্যাচেও কোনো দল এখনও পর্যন্ত ১৪০ করতে পারেনি। কানাডার ১৩৭ রানই এখানকার সর্বোচ্চ। সেই স্কোর নিয়েই তারা হারিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডকে। রোববার যেমন ১১৯ রান নিয়ে ভারত হারায় পাকিস্তানকে। নেদারল্যান্ডসের ১০৩ রান টপকাতে ঘাম ছুটে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার।
এখানেই সোমবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কঠিন চ্যালেঞ্জে নামবে বাংলাদেশ। ম্যাচের আগে যথারীতি উইকেট ঘিরে চলছে নানা আলোচনা, কৌতূহল, প্রশ্ন।
বাংলাদেশ দল অবশ্য বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছে। সবচেয়ে বড় কারণ, অবশ্যই প্রথম ম্যাচের জয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ হারসহ সাম্প্রতিক যে দুরাবস্থা ছিল দলের, সেই হতাশার মেঘ কিছুটা হলেও দূর করে নতুন আশার ঝিলিক হয়ে এসেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়। ডালাসে ওই ম্যাচ হেরে গেলে দলের মনোবল ধ্বংস হয়ে যেত হয়তো পুরোপুরি। কিন্তু সেই ম্যাচেজয়ের পর দল যে দারুণ চাঙা, তা ফুটে উঠল রোববার সংবাদ সম্মেলনে কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহের কথায়।
আমার মনে হয়, এই ফলাফলে ওরা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। একটি ম্যাচ খেলে কাঙ্ক্ষিত দুটি পয়েন্ট ওরা পেয়েছে। আমাদের জন্য অনেক বড় ম্যাচ ছিল এটি। ম্যাচের আগের সময়টায় প্রচণ্ড চাপ ছিল। তবে ছেলেদের প্রস্তুতি ভালো ছিল। ওরা ফল পেয়েছে।
ফুরেফুরে থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে উইকেটও। যে উইকেট এত ভয়ানক, সেখানে মিশে আছে তো বাংলাদেশের সম্ভাবনাও! উইকেটের কারণেই ম্যাচটি হয়ে উঠছে লটারির মতো।
এমনিতে শক্তি-সামর্থ্য-স্কিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছাকাছি নেই বাংলাদেশ। বিপক্ষে আছে ইতিহাসও। টি-টোয়েন্টিতে ৮ ম্যাচ খেলে সবকটিই জিতেছে প্রোটিয়ারা। তবে এখানকার উইকেট দুই দলকে নিয়ে আসছে কাছাকাছি। একই জায়গায় পিচ করে কোনো বল লাফাচ্ছে, কোনোটি নিচু হচ্ছে। স্রেফ জায়গামতো বল রাখলেই তা প্রায়ই হয়ে উঠছে বিপজ্জনক। স্কিলের কারিকুরি এখানে জরুরি নয়। দুই দলের ব্যবধান তাই কমে আসছে।
বাংলাদেশ কোচও ছোট্ট করে সেই কথাটি বলে নিজেদের আশার দুয়ার খুলে দিলেন।
ব্যাটারদের জন্য উইকেট খুব সহজ নয়। এই কারণেই আসলে দুই দল একই কাতারে চলে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণ বেশ ভালো। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী যে ওদের সঙ্গে খুব ভালো লড়াই করতে পারব।
এই মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা দুটি ম্যাচ খেলে ফেলেছে। খুব ভালো ধারণা তাই আছে তাদের। এখানে তারা নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবে। তাদের বোলিং আক্রমণও দুর্দান্ত। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের স্বস্তি বাংলাদেশের থাকলেও বড় দুর্ভাবনার জায়গাগুলো তো এখনও রয়েই গেছে। টপ অর্ডার তো একদমই ছন্নছাড়া!
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে লিটন কুমার দাস গুরুত্বপূর্ণ একটি ইনিংস খেলেছেন বটে। তবে কাজটা শেষ করে ফিরতে পারেননি তিনি, সেরা ছন্দ থেকেও অনেক দূরে আছেন তিনি। সৌম্য সরকার ও অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত যেন ব্যাট ধরতেই ভুলে গেছেন। নাসাউ কাউন্টির উইকেটে সৌম্যর বোলিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে ব্যাটিংয়ের যে অবস্থা, তাতে তাতে একাদশে রাখাই তো দায়।
ম্যাচের আগের দিন অনুশীলনের শুরুতে তানজিদ হাসান, শান্তর ও সঙ্গে নেটে দেখা গেল জাকের আলিকে। সৌম্য তখন প্যাড পরে বাইরে ব্যাট করার অপেক্ষায়। নেট সেশন দেখে যদিও ম্যাচের একাদশ সবসময় বোঝা কঠিন, তবে সৌম্যর জায়গায় একাদশে জাকেরকে দেখা গেলে অস্বাভাবিক কিছু হবে না।
একাদশে আরেকটি কৌতূহলের জায়গা থাকবে শরিফুল ইসলামকে নিয়ে। প্রস্তুতি ম্যাচে চোট পাওয়ার পর হাতে ছয়টি সেলাই নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলতে না পারা এই বাঁহাতি পেসার রোববার নেটে পুরোদমে বল করেছেন। হাতে কোনো ব্যান্ডেজও নেই। শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরো প্রস্তুত হলে তাকে এই ম্যাচে খেলানো হবে।
শরিফুল না খেললেও অবশ্য বোলিং নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। শঙ্কার প্রায় সবটুকুই ব্যাটিং, তথা টপ অর্ডারের ব্যাটিং ঘিরে। ব্যাটসম্যানদেরপরামর্শ দেওয়া কিংবা তাদের সঙ্গে আলোচনা, কোনো কিছুরই কমতি রাখা হচ্ছে না বলে জানালেন হাথুরুসিংহে। কিন্তু কোচ তো আর মাঠে নেমে খেলে দিয়ে আসতে পারেন না! মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ব্যাটসম্যানদেরই, মনে করিয়ে দিলেন কোচ।
আমরা ওদের খেলা নিয়ে, শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে ও ওদের প্রতিপক্ষ নিয়ে কথা বলতে পারি। তবে মাঠে নামার পর ব্যাপারটা পুরোপুরিই তাদের নিজেদের। নিজের খেলা বুঝতে হবে তাদের। এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার নয়। তাদের আউটের দিকে তাকালে দেখবেন, নির্দিষ্ট কোনো ধরনে তারা আউট হচ্ছে না। অনেকভাবে আউট হচ্ছে। তাদেরকে আরেকটু শান্ত হতে হবে এবং নিজেদের শক্তির জায়গা ভাবতে হবে। আত্মবিশ্বাস থাকলে নিজেদের শক্তি অনুযায়ী খেলা যায়। ব্যাটারদের জন্য বার্তা হলো, ভালো সময়ের কাজগুলির পুনরাবৃত্তি করো।
যে কোনো খেলাতেই নিজের শক্তির জায়গায় অটল থাকতে হয়। যে কোনো ব্যাটারের জন্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কন্ডিশন। পরিস্থিতি ও কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে কাজটা কঠিন। প্রথমে ব্যাট করলে আমাদের কী করতে হবে, পরে ব্যাট করলে কী করতে হবে, এসব নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা। নিজের শক্তির জায়গায় স্থির থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটির বড় অংশই হলো কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।
নাসাউ কাউন্টির উইকেটে মানিয়ে নেওয়ার কাজটি কঠিন। তবে বাংলাদেশ কোচের স্বপ্ন বেশ রঙিন। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও হারিয়ে সুপার এইটে স্বপ্নের দুয়ার খুলতে চান তিনি।
প্রতিটি ম্যাচই চাপের। আমাদের জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আমরা এমন কিছু করতে চাই, আগে কখনোই যা করতে পারিনি, দ্বিতীয় ধাপে যেতে চাই। সেই লক্ষ্য পূরণের পথে আরেকটি বড় সুযোগ এই ম্যাচ।
এমটিআই