ঢাকা : সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, রাত ঠিক ১২টা। হাতে কেক আর তার ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে সার্জিও আগুয়েরো আর ডি মারিয়ারা। সুরে সুরে হ্যাপি বার্থডে গানে শুভেচ্ছা জানান ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসিকে। লিওনেল স্কালোনিসহ সতীর্থরা তার হাতে তুলে দেন আলাদা আলাদা উপহার। ব্রাজিলের মারাকানায় সেদিন নিজের ৩৫তম জন্মদিনটা সতীর্থদের সঙ্গে উদযাপন করেন মেসি। ২০২১ সালে করোনাকালীন পৃথিবীতেও তখন চলছিল লাতিন ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর কোপা আমেরিকা।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে তখন মেসির ঝুলিতে ট্রফির সংখ্যা শূন্য। তিন বছর পর যখন আবারও একটি কোপা আমেরিকার আসর বসল, তখনো মাঝে সতীর্থরা পেয়ে গেলেন মেসির জন্মদিন। আজ আর্জেন্টাইন মহাতারকার পাওয়ার আর কিছুই নেই। ঝুলিতে আছে ফুটবলের সম্ভাব্য সব শিরোপা। সতীর্থদের চমকে দেওয়া সেই রাতের পরই জিতেছিলেন কোপার শিরোপা। তার পরের বছর কাতারে জিতে নেন পরম আরাধনার বিশ্বকাপ।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবল ভক্তদের কতশত মনে রাখার মুহূর্ত দিয়েছেন তিনি গত ১৮ বছরে। কিন্তু তিনি পাচ্ছিলেন না কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফির দেখা। অবশেষে ক্যারিয়ারের ১৬তম বছরে গিয়ে মেসিকে ঋণ শোধ করে পৃথিবী। জাদুকরের হাতে ওঠে ফুটবল বিশ্বকাপ; যা ছিল ১৯৮৬ সালের পর আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের সাধনা। সেই সাধনার নায়ক আজ পূরণ করতে চলেছেন ৩৭ বসন্তের। সেটাও আরেকটি কোপা চলাকালেই।
জীবনের ৩৬টি বছর পেছনে ফেলে এসেছেন ফুটবলের এই বরপুত্র। কত রাস-উৎসবই না হয়েছে তার বিশেষ দিনে। কিন্তু গতবারের মতো এবারের জন্মদিনটাও যে আলাদা। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মেসির এটা দ্বিতীয় জন্মদিন। মেসির জন্মের পর আর্জেন্টিনা প্রথম বিশ্বকাপ জেতে তার পায়ের জাদুতেই। টানা চার বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়া মেসি পঞ্চম বিশ্বকাপে এসে ছোঁয়া পেয়েছিলেন শিরোপার।
বিশ্বকাপ জিততে যেমন লড়াই করতে হয়েছে মেসিকে, তেমনি ফুটবলার হতে গিয়েও বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। রোজারিওর স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলি থেকে নিওয়েলস ওল্ড বয়েজে চমক দেখিয়েছিলেন শৈশবেই। ছোটদের লিগের ফুটবলার হয়েও বড়দের ম্যাচের বিরতির সময় বল নিয়ে কলাকৌশল দেখাতেন। ফলে অল্পদিনেই ক্ষুদে প্রতিভা হিসেবে সাড়া জাগান তিনি।
২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে বার্সেলোনায় মেসির একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মেসির খেলা দেখে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ফার্স্ট টিম ডিরেক্টর কার্লেস রেক্সাচ মুগ্ধ হয়ে তাকে দলে নিতে চান। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ঘটে সেই বিখ্যাত ঘটনা, হাতের কাছে কাগজ না পেয়ে ন্যাপকিনে বার্সেলোনায় মেসিকে সই করিয়েছিলেন রেক্সাচ। সেই ন্যাপকিন সম্প্রতি বিক্রি হয়েছে, যার মূল্য ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১ কোটি টাকা। সেদিন চুক্তির সময় মেসির চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিল বার্সেলোনা। এই একটা ঘটনাই মেসির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
তারপর গোটা ফুটবল বিশ্বকে রাজত্ব করেছেন। সেটা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। নিজের ১৮তম জন্মদিনে বার্সেলোনার পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। তারপরের গল্পটা সবারই জানা। বার্সেলোনার হয়ে নয়বার লা লিগা জিতেছেন। তার যোগদানের পর কাতালানরা ইউরোপসেরা হয়েছে চারবার।
ক্লাব ফুটবলে কোনো শিরোপাই তার বাকি ছিল না। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ছিল না কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা। একাধিকবার খুব কাছে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। অবশেষে বার্সা ছেড়ে মেসি পাড়ি দেন ফরাসিদের রাজধানী প্যারিসে। ক্লাব পিএসজিতে যোগ দিতেই বদলে যায় তার ভাগ্য। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথমবার কোনো শিরোপা জয় হয় মেসির। অধরা বিশ্বকাপটাও মেসি করায়ত্ত করেছেন। মরুভূমির বুকে তারার আলোয় ফুটবলের কালপুরুষ হাতে তুলে নিয়েছেন আরাধ্য সেই সোনালি স্মারক।
বিশ্বকাপ জিতে অবশ্য তৎকালীন ক্লাব পিএসজির সমর্থকদের থেকে নিয়মিত শুনতে হয়েছে দুয়ো। কারণ ফ্রান্সকে হারিয়েই যে মরুর বুকে ফুটবলের বিশ্বজয় করেছিলেন মেসি। প্যারিসিয়ান ক্লাব থেকে কোনো সংবর্ধনাও পাননি বলে অভিযোগ করেছিলেন লা পুলগা। ফলে ক্লাবটিতে তার শেষ বেলার পরিণতিটা হয় ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতোই। নেপোলিতেও ফুটবল ঈশ্বরের শেষটা এমনই হয়েছিল। মৌসুম শেষে মেসি তাই ইউরোপ থেকেই বিদায় নেন। যোগ দেন মেজর লিগ সকারের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে। গিয়েই ক্লাবটিকে এনে দিয়েছিলেন লিগস কাপের শিরোপা। যে জয়ে রেকর্ড ৪৪ টুর্নামেন্ট জয়ের রেকর্ড গড়েন তিনি।
কিছুদিন আগেই বাজারে এসেছে মেসি মালিকানাধীন স্পোর্টস ড্রিংক মাস+। বোঝাই যায়, ফুটবলটা এখন শুধুই উপভোগ করছেন তিনি। শুধুই ভালো লাগার জায়গা থেকে গায়ে জড়াচ্ছেন তিন তারকাসংবলিত আর্জেন্টিনার জার্সি।
এমটিআই