ঢাকা : একপর্যায়ে বাংলাদেশ ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়েছিল নয় ওভার শেষে। তার মানে, ১৯ বলে দরকার ছিল ৪৩ রান। তাহলেই খুলে যেত সেমিফাইনালের কপাট। ১২.১ ওভারে লক্ষ্য ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশ সরে আসে ২৩ রানে তিন উইকেট হারিয়ে। তখন লক্ষ্য হয় সান্ত্বনার জয়। সেই জয়ও সোনার হরিণে পরিণত হয়। এটিকে কী বলবেন?
সম্ভাব্য উত্তর-সাহসের অভাব। সামর্থ্যরে ঘাটতি। নেতিবাচক মনোবৃত্তি। চেষ্টার কমতি। কমতি বললে ভুল হবে। বাংলাদেশ তো আসলে কোনো চেষ্টাই করেনি। রশিদ খানরা যখন জেতার জন্য মরিয়া, নাজমুলরা তখন হতোদ্যম, দিকভ্রান্ত!
বাংলাদেশ সুপার এইটে ওঠার পর বিসিবি সভাপতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান কিশোরগঞ্জে এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ হারতে পারে; কিন্তু কাউকে ভয় পায় না। লড়াই করে জিতব আমরা।’
কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই বক্তব্য হয়ে গেল হাস্যকর।
দীর্ঘদিন ধরে যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তা থেকে শুরু করে ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফদের বক্তব্যে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র বিষয়টি স্পষ্ট সামনে চলে আসছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে ‘টাইগাররা’ দেখালেন, তারা কতটা দুর্বলচিত্তের। টি ২০ ক্রিকেটের এই যুগে হাতে ১০ উইকেট নিয়েও ৭৩ বলে ১১৬ রানের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কোনো চেষ্টাই করল না বাংলাদেশ।
কোচ ও সাবেক ক্রিকেটাররা মনে করছেন, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং সামর্থ্যরে ঘাটতির দরুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস হয়নি। এরই মধ্যে বিসিবির সঙ্গে সম্পৃক্ত বা বিসিবিতে চাকরি করেন, এমন সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ এই বিষয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক। কথা বলতে চাইলে চাকরি হারানোর ভয়ে ‘দুঃখিত’ বলে সরে গেছেন অনেকে।
এর মধ্যে সাবেক এক ক্রিকেটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই অবস্থার উন্নতির জন্য সব জায়গায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। ঢেলে সাজাতে হবে সব কিছু। ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ার থেকে শুরু করে যারা দায়িত্বে আছেন, সব জায়গায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নেই। সব জায়গার দুর্বলতা রঙিন পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখে সমর্থকদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়।’
সাকিব আল হাসানদের ছোটবেলার কোচ, বাংলাদেশ দলের অধিকাংশ ক্রিকেটার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখা ক্রিকেট বিশ্লেষক ও কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম বলেন, ‘যে চ্যালেঞ্জটা আমাদের নেওয়ার দরকার ছিল সেটা শুধু ক্রিকেটার নয়, যারা সংশ্লিষ্ট তাদের কারোরই আছে বলে মনে হয় না। আমরা কখনোই চ্যালেঞ্জ নিতে চাই না। আমরা সেভাবেই গড়ে উঠিনি। ক্রিকেটারদের সেভাবে তৈরি করা হয়নি। তারপরও এখানে অন্তত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যারা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার তাগিদ ছিল না। শুধু স্কিলের ব্যাপার না। আমরা যে দল হিসাবে মানসিকভাবেও কত দুর্বল, তা সবাই দেখল। সবাই জেনে গেল, এটা লজ্জার।’
২০ দলের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সুপার এইটে উঠলেও বাস্তবে অবস্থান কেমন? নাজমুল আবেদিন বলেন, ‘নেপালের সঙ্গে জিতে যে উল্লাস করি শুধু খেলোয়াড় না, আমরাও যেটা করি তাতেই বোঝা যায় কতটা নিচে নেমে গেছি আমরা। অনেকের মধ্যে তৃপ্তি থাকতে পারে আমরা তিনটি ম্যাচ জিতে গেছি। তাতে সন্তুষ্টি চলে আসতে পারে। এটাই ব্যর্থতার মূল কারণ আমাদের।
আমরা কেন ক্রিকেট খেলি, ক্রিকেট কোথায় নিয়ে যেতে চাই, সেই বিষয়ে হয়তো আমরা যারা ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদেরও পরিষ্কার ধারণা নেই। সব কিছু মিলে হতাশার। বিশ্বকাপ দিয়ে বোঝা যায়, আমরা ক্রিকেটে কোন অবস্থায় আছি।’
উত্তরণের পথ কী? নাজমুল বলেন, ‘অবশ্যই আছে। মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলে সফলতা আসবে না। ভালো করার বাস্তবমুখী চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। দৃঢ় মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। খেলোয়াড়দের আমরা সেটা তৈরি করে দিতে পারছি না। তাই তারাও যে মানসিকতায় গড়ে উঠছে তাতে গোঁজামিল থেকে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে। বড় কিছু করতে বড় মানসিকতা নিয়ে সবাইকে এগোতে হবে।’
সাবেক ডান-হাতি পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত বলেন, ‘আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে পারিনি সত্যি। এটা না নিতে পারার কারণ ঘরোয়া ক্রিকেট। এই ফরম্যাটে আমাদের শুধু বিপিএল খেলা হয়। শুধু বিপিএল দিয়ে সব কিছু যাচাই করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আত্মবিশ্বাস-মনোবল সবই দুর্বল। নিজেদের প্রতি বিশ্বাসও কম। যে চ্যালেঞ্জটা ছিল, সেটা এই যুগে অবশ্যই নেওয়ার কথা। আমাদের ব্যাটাররা এখনো নিজেদের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে এগোতে পারছে না। এমনিতেই আমাদের শক্তি কম। আমরা কী চাচ্ছি, আমাদের লক্ষ্যে কী-এগুলো ঠিক করে এগোতে হবে। ওয়ানডেতে আমরা অনেকদিন ধরে কিছুটা ভালো করছি। কারণ এই ফরম্যাটে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেকদিন ধরে খেলা হয়। বোলিংটা ভালো হচ্ছে। কারণ এই জায়গায় বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা বাড়াতে হবে। মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে। কোচিংয়ের পর ক্রিকেটাররা কী করেন সেটা তো কোচদের জানার কথা নয়।’
ক্রিকেটারদের এমন ভঙ্গুর মানসিকতায় অবাক সাবেক দুই অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা ও তামিম ইকবাল। মাশরাফি বলেছেন, ‘ম্যাচের হিসাবটা ছিল শুধুই ১২.১ ওভারের। এর বাইরে কিছুই ভাবার সুযোগ ছিল না। তাতে দল যদি ৫০ রানেও অলআউট হতো, তাহলে অন্তত সবাই সহজভাবে নিত। আর যদি (সাবধানী খেলে) ম্যাচটা এভাবে জিততাম, তা-ও বিবেকের কাছে হেরে যেতাম।’
ক্রিকইনফোতে তামিম বলেছেন, ‘আমি কারও দিকে আঙুল তুলব না। বাংলাদেশ শুরুটা ভালো করেছিল। সুপার এইটে ভালো না করলেও সুযোগ ছিল সেমিফাইনালে যাওয়ার। যদি তারা হেরেও যেত ৩০ বা ৪০ রানে, যদি রান তাড়ার চেষ্টাটাও করত তাহলে সমর্থকরা বুঝত যে সুযোগ ছিল আমরা চেষ্টা করেছি, পারিনি সমস্যা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি কিছুটা অবাক হয়েছি যে, একপর্যায়ে মনে হয়েছে যে তারা রানটা তাড়া করতে না চেয়ে ভেবেছে শুধু জেতার চেষ্টা করে দেখি, যা আমার পছন্দ হয়নি।’
ক্যারিবীয় লিজেন্ড ইয়ান বিশপ গত পরশু ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিট সম্ভাবনাময়। ব্যাটিং বিভাগেও একই গতিতে উন্নতি করতে হবে।
আরেক সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার ড্যারিন গঙ্গা উপমহাদেশের বাইরের কন্ডিশনে বাংলাদেশকে বেশি করে ম্যাচ খেলার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে একটি গণমাধ্যমকে সাবেক অধিনায়ক ও নির্বাচক হাবিবুল বাশার বলেন, ‘টি ২০ ফরম্যাটে সাকিব ও রিয়াদের (মাহমুদউল্লাহ) ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের সঙ্গে বসতে হবে বোর্ডকে।’
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :